এক থেকে দেড় মাসে সব ধরনের মসলার দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, বাজার মনিটরিংয়ের তাগিদ ক্রেতাদের
রসুইঘরে মসলার কদর আদিকাল থেকেই। বাঙালিদের মুখে মসলা ছাড়া তরকারি রোচে না। বিশেষ করে মাছ-গোশতের স্বাদ বাড়াতে মসলার জুড়ি মেলা ভার। কয়েক দিন পর মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ)। সামর্থ্যবানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেবেন। ধনীরা গোশত গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেবেন। মুসলমানদের ঘরে ঘরে থাকবে গোশত। গোশত রান্নার অন্যতম উপকরণ মসলা। আর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বাজারে আদা, রসুন, জিরা থেকে শুরু করে গোশতের সব ধরনের মসলার দাম বেড়েছে। শুধু বেড়েছে বললে ভুল হবে, বলা চলে গত বছর থেকে এ বছর মসলার দাম দ্বিগুণেরও বেশি। মসলার দামে যেন আগুন লেগেছে। দামের কারণে ভোক্তার নাভিশ্বাস অবস্থা। অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদের এক মাস আগে থেকেই পণ্যবাজার অস্থিতিশীল। সয়াবিন, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, জিরাসহ অন্যান্য মসলার দাম এখন ঊর্ধ্বমুখী। পণ্যের লাগামহীন দামে দিশেহারা মানুষ। তবে দিন যত যাবে বাজার আরো ঊর্ধ্বমুখী হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সরবরাহ সংকটের সুযোগে বাড়তি মুনাফা করতে আমদানিকারকরা বাজার অস্থির করে তুলছে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলছেন, ঈদকে ঘিরে আদাসহ দু-একটি মসলার দাম বেড়েছে। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোক্তা অধিকার অ্যাকশনে যাবে। মসলার দাম যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সেদিকে নজর রয়েছে। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে, তবে তা ধীরগতিতে। অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভোক্তা অধিকারকে বলা হয়েছে। নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুত পেলে প্রতিষ্ঠান সিলগালাসহ জরিমানা করা হবে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে চাইলে অ্যাকশনে যাওয়া যায় না উল্লেখ করে টিপু মুনশি বলেন, তারা যদি সবকিছু বন্ধ করে দেন, তবে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে পড়তে হবে। তাই আমাদের ব্যালান্স করে চলতে হচ্ছে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করেন। তবে আমরা চেষ্টা করছি, যেন তারা সুযোগটা না নিতে পারেন। ক্রেতাদের অভিযোগ গত এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সব ধরনের মসলার দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বাজারে যথাযথ মনিটরিং না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাজার মনিটরিংয়ের তাগিদ তাদের।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ডলার সংকট এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের কারণে আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটায় সরবরাহ ঘাটতি দেখা দিয়েছে দেশের মসলার বাজারে। আর এতে গত তিন মাসে অনেকটাই বেড়েছে মসলার দাম। অবশ্য রাজধানীর নিউমার্কেট-কারওয়ান বাজার-শাহ আলীসহ দেশের বড় মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে মসলার দামের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিক্রেতারা ইচ্ছেমতো দাম রাখেন, যার প্রভাব পড়ছে বাজারে। আবার বন্দরে মসলা পণ্য ছাড়ে বেশি সময় লেগে যাওয়ায় দাম বেড়ে যায়, এমন অভিযোগ আমদানিকারকদের।
মসলা আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, জিরা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো মসলা পণ্যের দাম তেমন বাড়েনি; বরং কিছু কিছু পণ্যের দাম আগের চেয়ে কমেছে। অথচ দেশে সব ধরনের মসলার দামই ঊর্ধ্বমুখী। বাজারদর ও পাইকারি মসলা ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত তিন থেকে ছয় মাসে মসলা পণ্যের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে জিরার দাম। মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের প্রধানতম গরম মসলার একটি জিরা। কিন্তু জিরা, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ ও এলাচের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি আসন্ন কোরবানির ঈদে ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৭৭০ থেকে ৮৫০ টাকায়। বিভিন্ন হাত ঘুরে এই জিরা খুচরা পর্যায়ে ১,০০০ টাকারও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানান, তিন মাস আগেও ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে জিরা, যা বর্তমান দামের চেয়ে প্রায় ৪৫০ টাকা কম। অথচ হিলি স্থলবন্দর কার্যালয়ের তথ্য বলছে, চলতি জুন মাসে বন্দর দিয়ে জিরার আমদানি কিছুটা বেড়েছে। এ মাসের ১৯ জুন পর্যন্ত ৪৯টি ট্রাকে এক হাজার ৪০২ টন জিরা আমদানি হয়েছে।
একইভাবে কেজিতে ৪০০ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি কেজি এলাচ ১,৫০০ টাকা; ৭০০ টাকা বেড়ে লবঙ্গ ১,৫০০ টাকা; ১,০০০ টাকা বেড়ে জায়ফল ৩,০০০ টাকা; ২০০ টাকা বেড়ে মিষ্টি জিরা ৩১০ টাকা; ১৫০ টাকা বেড়ে গোলমরিচ ৬৭০ টাকা; ১৫০ টাকা বেড়ে জয়ত্রী ৭৫০ টাকা; ৭০ টাকা বেড়ে দারুচিনি ৩২০ টাকা; ৬০ টাকা বেড়ে ধনিয়া ১৮০ টাকা; ৫০ টাকা বেড়ে সরিষা ১০৫ টাকা এবং ২০ টাকা বেড়ে তেজপাতা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।
এছাড়া, পেঁয়াজের পর এবার বড় লাফ রসুনের বাজারে। গত তিন দিনের ব্যবধানে মসলাজাতীয় পণ্যটির দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা। একই সঙ্গে মাঝে ক’দিন কমে আবারও বাড়তির দিকে আদা। অন্যদিকে আমদানি করা পেঁয়াজে বাজার ভরে গেলেও নাগালে আসেনি দেশি পেঁয়াজ। তিন দিন আগে রাজধানীর খুচরা বাজারে আমদানি করা রসুনের কেজি বিক্রি হয়েছে কমবেশি ১২০ টাকা। তবে গতকাল কারওয়ান বাজার, মালিবাগ ও হাতিরপুল কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে রসুন বিক্রি হয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। আমদানি করা সাদা রসুনের কেজি ছিল ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। দাম বেড়ে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা দরে। আর আমদানি করা হালকা লালচে রসুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকা। তিন দিন আগে লালচে রসুনের দাম ছিল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর তথ্য মতে, গত এক বছরের তুলনায় দেশি রসুনের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৩ শতাংশেরও অধিক।
মাস খানেক আগে আদার দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় ওঠে। তবে ধীরে ধীরে দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু গত তিন-চার দিনে আবার আদার দর কিছুটা বেড়েছে। বাজারে সব সময় কমবেশি চায়না আদার সরবরাহ থাকে। কিন্তু এক-দেড় মাস ধরে চায়না আদার কমই দেখা মিলছে। দেশি আদার পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও ভুটানের আদা দিয়েই এখন চাহিদা মিটছে। মানের দিক থেকে কিছুটা ভালো ইন্দোনেশিয়ার আদার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। চার দিন আগে এ আদা ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি ছিল। কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁ স্টোরের বিক্রেতা অবদুল হক বলেন, বাজারে কিন্তু আদা-রসুনের কমতি নেই। এরপরও তিন দিন ধরে পাইকারি বাজারে বাড়ছে রসুনের দাম। আদার দাম মাঝে কমে এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে।
স্বাভাবিক সময়ে ১৫০-২৫০ টাকার মধ্যে শুকনামরিচ বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ঠেকেছে ৪৫০-৫০০ টাকায়। তবে মসলাপণ্যের মধ্যে স্থির থেকে ১২৫-১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে আস্ত শুকনা হলুদ।
এদিকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে হু হু করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দর। আমদানির অনুমতি দেয়ায় প্রতিদিনই পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের প্রচুর সরবরাহ দেখা গেছে। খুচরা পর্যায়ে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা দরে এসব পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু দেশি পেঁয়াজের তেজ এখনও সে তুলনায় কমেনি। দেশি পেঁয়াজ কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আর পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫২-৬০ টাকা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দেখা গেছে, গত বছরের এ সময় দেশি রসুনের কেজি ৫০ থেকে ৮০ টাকা আর আমদানি করা রসুনের দাম ছিল ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। সংস্থাটির তথ্য বলছে, এক সপ্তাহে আমদানি করা রসুনের দাম বেড়েছে কেজিতে ২০ টাকা। এ ছাড়া এক বছরে দেশি আদার দাম বেড়েছে ২৫৭ শতাংশ আর আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে ২৫৩ শতাংশ।
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক মেসার্স অসীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী অসীম কুমার দাশ জানান, বাংলাদেশের অধিকাংশ মসলাপণ্যই আমদানি হয় বিশ্ববাজার থেকে। এক সময় ব্যবসায়ীরা ৮২ থেকে ৮৪ টাকার ডলার দিয়ে পণ্য আমদানি করত। এখন ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১১২ টাকা। পণ্যের দামের ওপর শুল্ক নির্ধারণ হওয়ায় আমদানি খরচ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। যার কারণে মসলাপণ্যের দাম অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি। এছাড়া, বিলাসী পণ্য হিসেবে মসলা আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি ছাড়াও আমদানি কমে যাওয়ায় আসন্ন কোরবানির ঈদে দেশে মসলার দাম চড়া থাকবে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স নাজিম ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. নাজিম উদ্দিন বলেন, দেশে যে পরিমাণ মসলার চাহিদা রয়েছে তার চেয়ে আমদানি অনেক কম। কোরবানির ঈদে গরম মসলার চাহিদা থাকে কয়েক গুণ বেশি।
তিনি বলেন, ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে আমদানিকৃত গরম মসলার দাম বেড়েছে। আমদানি সংকট নিরসন ছাড়া দেশে মসলার বাজার স্থিতিশীলতায় ফেরার কোনো সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা মসলাপণ্য ব্যবসায়ী সমিতির (হামিদুল্লাহ মার্কেট) সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিচ মিয়া আদা-রসুনের দাম নিয়ন্ত্রণে ও আমদানি নীতির ওপর সংশ্লিষ্টদের জোর দেয়ার আহŸান জানান।
এদিকে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর ভ‚ঁইয়া বলেন, চিনি, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, জিরাসহ অন্যান্য মসলাপাতি ভারতে দাম কম কিন্তু বাংলাদেশে দাম লাগামীহনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে দাম বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থা মনিটরিং করার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগসম‚হকে যুগোপযোগী করতে হবে। সড়কে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন হয়রানি বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আমদানিকৃত পচনশীল পণ্য স্থল ও নৌ বন্দর হতে দ্রæত খালাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং গরুর গোশতের দাম কমাতে ভারত থেকে ১ লাখ গরু আমদানি করা দরকার। তাহলে পণ্যের দাম অনেকটা কমে আসবে।