দেশে নারী হত্যা ও নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত দেড় মাসে সারা দেশে নির্যাতনে অন্তত ৬৫ জন নারীর মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৩ জন নারীকে। তার মধ্যে চলন্ত বাসে ধর্ষণচেষ্টার সময় এক তরুণীকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনাও রয়েছে।
অন্যদিকে গত দেড় মাসে শুধু রাজধানীতে সাত নারীকে হত্যা এবং ১০ নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, ক্ষোভ-হতাশা, মাদক বেচাকেনা, সম্পত্তির লোভ, পরকীয়া প্রেম, আয়বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা।
গত ১৬ জুন রাতে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে চলন্ত বাস থেকে এক গার্মেন্টকর্মীকে ফেলে হত্যা করা হয়।
রাতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বাসের চালক, হেল্পার, সুপারভাইজারকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
ভালুকা মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) মোহাম্মদ কামাল হোসেন বলেন, ওই দিন রাতে গার্মেন্টকর্মী গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার নয়নপুর থেকে কাজ শেষে হাইওয়ে মিনিবাসে ভালুকায় আসছিলেন। পথে বাসের চালক রাকিব (২১), হেল্পার আরিফ (২০) এবং সুপারভাইজার আনন্দ দাস (১৯) তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান।
এ সময় নির্যাতিতার চিৎকারে ধর্ষণচেষ্টাকারীরা তাঁকে ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ী এলাকার মায়ের মসজিদের কাছে চলন্ত বাস থেকে রাস্তায় ফেলে দেন। খোঁজ পেয়ে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দিলে ওই তরুণীকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে ভালুকা ৫০ শয্যা সরকারি হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
আরেক ঘটনায় গত ২৭ মে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ী দক্ষিণ হরিণাচালা এলাকায় নির্যাতনের পর এক নারীকে হত্যা করা হয়। ওই নারীর নাম মরিয়ম খাতুন (৩৩)। তিনি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের হরিপুর গ্রামের শফিজ উদ্দিনের মেয়ে।
স্বামী জয়নালের সঙ্গে কোনাবাড়ী দক্ষিণ হরিণাচালা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ওই দিন রাতের কোনো একসময় মরিয়মকে মারধরের এক পর্যায়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে স্বামী জয়নাল পালিয়ে যান। পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পারিবারিক বিরোধে প্রায়ই জয়নাল স্ত্রীকে নির্যাতন করতেন।
এদিকে গত ১৪ জুন রাজধানীর বাড্ডায় দুধের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্ত্রী মাহমুদা হক বৃষ্টি এবং শিশুকন্যা সানজা মারওয়াকে হত্যার অভিযোগে সেলিম নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। স্বজনদের অভিযোগ, পরকীয়া প্রেমের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে পরকীয়া প্রেম।
এর আগে গত ১০ মে রাজধানীর সবুজবাগে বাসা ভাড়া নেওয়ার কথা বলে গৃহকর্ত্রীকে বিষ খাইয়ে হত্যা এবং স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে একটি চক্র। নিহত নারীর নাম হাসিনা বেগম (৫০)।
হাসিনা বেগমের স্বামী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, দুই নারী ও এক পুরুষ তাঁদের বাসায় আসে রুম ভাড়া নিতে। তারা কিছু টাকা অ্যাডভান্সও করে যায়। ১০ মে সকাল ১১টার দিকে আবার আসে তারা। সঙ্গে জুস, ফলমূল, মাংসের তরকারি নিয়ে আসে। ওই সময় আবু বক্কর বাসার বাইরে ছিলেন। দুই নারী বাসায় প্রবেশ করে জুস বানিয়ে গৃহকর্ত্রীকে খাইয়ে অচেতন করে ঘরে থাকা নগদ টাকা পয়সা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। পরে পরিবারের লোকজন অচেতন অবস্থায় হাসিনা বেগমকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
গত ২১ মে তেজগাঁও এলাকায় জুলেখা খাতুন নামের এক নারীকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই এলাকার একটি বহুতল ভবনের নিরাপত্তারক্ষীর কক্ষ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ বিষয়ে তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম বলেন, ব্যক্তিগত বিরোধের জের ধরে জলিল নামের এক রিকশাচালক জুলেখাকে হত্যা করে। জলিলের সঙ্গে জুলেখার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৩১ মে রাজধানীর দক্ষিণখান দক্ষিণপাড়া এলাকায় আফরোজা আক্তার নামের এক নারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ জানতে পারে, তাঁকে হত্যার পর মাটিচাপা দেওয়া হয়। এ ঘটনায় নিহতের ভাই আরিফুল ইসলাম বাদী হয়ে দক্ষিণ খান থানায় আফরোজার কানাডাপ্রবাসী স্বামী আশরাফুল আলমকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করেন। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, পারিবারিক বিরোধ থেকে ওই নারীকে তাঁর স্বামী পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেন।
গত ৯ জুন রাজধানীর রামপুরা এলাকায় নিনা খান নামের এক গৃহবধূকে নৃশংসভাবে হত্যার পর তাঁর লাশ পুড়িয়ে ফেলার অভিযোগ পায় পুলিশ। এ ঘটনা তদন্তের পর রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, পারিবারিক বিরোধের জেরে ওই নারীকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তাঁর স্বামী গিয়াসউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত ১৪ জুন পুরান ঢাকার কদমতলী পাটেরবাগ এলাকায় স্বামীর নির্যাতনে শারমিন আক্তার নামের এক গৃহবধূর মৃত্যুর অভিযোগ পায় পুলিশ। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী আলামিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এ ছাড়া সম্প্রতি হাতিরঝিল এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ বলেছে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
রাজধানীতে ১০ নারীর লাশ উদ্ধার : গত দেড় মাসে রাজধানীতে অন্তত ১০ নারীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। গত ৬ মে কামরাঙ্গীর চরে একটি বাসা থেকে তানজিলা ইসলাম দিপ্তী নামের এইচএসসির এক শিক্ষার্থী, ২৬ মে রাজধানীর তেজগাঁও থানার কুনিপাড়া এলাকায় ফিরোজা বেগম (৫০) নামের এক নারী, ২৩ মে পুরান ঢাকার কদমতলী থানার জুরাইন এলাকা থেকে মুন্নি আক্তার নামের এক গার্মেন্টকর্মী, ২১ মে রাজধানীর সবুজবাগ ওহাব কলোনির একটি বাসা থেকে নূপুর খাতুন নামের এক গৃহবধূ, একই দিন রাজধানীর খিলগাঁও থানার দক্ষিণ বনশ্রীতে জারা ফেরদৌস বিন্দু (১৭) নামের এক শিক্ষার্থী, ১৮ মে সবুজবাগে তমা আক্তার (১৫) নামের এক গার্মেন্টকর্মী, ১৬ মে হাজারীবাগ এলাকা থেকে ইয়ানুর বেগম শিল্পী, ৪ মে শাহজাহানপুর ও সবুজবাগ এলাকার দুটি বাসা থেকে লুবনা বেগম ও হোসনে আরা আক্তারের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারে যে সুশৃঙ্খল পরিবেশ থাকার কথা বর্তমানে বেশির ভাগ পরিবারে তা নেই। পারিবারিক বন্ধনও দুর্বল হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। এ কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডও বাড়ছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান মো. সাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে, বিশেষ করে নগরজীবনে। সেখানে জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যে বন্ধন থাকার কথা, সেটি অনেক সময় আর থাকছে না। যে যার মতো করে চলতে গিয়ে চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে ঝামেলা তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামে বেশির ভাগ পারিবারিক সহিংসতার মূলে রয়েছে জমিজমা নিয়ে বিরোধ।’
এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। কারণ শাস্তি না হওয়ায় মানুষ অপরাধ করতে ভয় পায় না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পারিবারিক ঘটনায় অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অনেকে হত্যার শিকার হচ্ছে। তবে স্বজনদের হাতে স্বজন হত্যার বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/21/1291948