গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। দেশের মোট বিদ্যুৎ গ্রাহকদের প্রায় ৫৫ শতাংশ সংস্থাটির অধীনে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটতি বেশি হচ্ছে। রাতেও হচ্ছে কিছু কিছু। কর্মকর্তারা একদিকে ইচ্ছামাফিক লোডশেডিং করছেন; অন্যদিকে কোটি কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে নতুন লাইন সংযোগ দিচ্ছেন। মূলত বদলে হয়ে আসার ঘুষের টাকা উঠাতেই নতুন নতুন লাইন সংযোগ দেয়া এবং ওই সব লাইন চালু রাখতে লোডশেডিং বেড়ে গেছে। ঘুষ বাণিজ্য করায় সংস্থাটির ‘চেইন অব কমা- কার্যত ভেঙ্গে পড়েছে’। আরইবি’র সবই সর্বসর্বা বলে গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরইবি’র বিদ্যুতের বিতরণ লাইনের এক-তৃতীয়াংশই ওভারলোডেড। সক্ষমতার চেয়ে বেশি সংযোগ প্রদান ও পুরনো লাইনের কারণে বিতরণ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই অল্প ঝড়-বৃষ্টিতে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের বিতরণ ব্যবস্থায় সাধারণত তিনটি লাইন থাকে। ঝড়-বৃষ্টির সময় গাছের ডাল পড়ে শর্টসার্কিট হয়ে অনেক সময় লাইন ট্রিপ করে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া থাকলেও বজ্রপাতের সময় অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে ট্রান্সফরমার পুড়ে যায়। এতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘিœত হয়।
গতকাল মঙ্গলবার একটানা ৭ ঘন্টায় বিদ্যুৎ ছিল না আশুলিয়ার জিরানী, গোহাইলবাড়ী ও এর আশপাশ এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে ঢাকা-১, ঢাকা-২ এবং ঢাকা-৩ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তরা লাইন সংস্কারে নামে নিজেরাই লোডশেডিং সৃষ্টি করে। আর নতুন লাইন সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা ঘুষ আদায় করছেন। এ কারণ বলা হয়েছে কোটি টাকা দিয়ে বদলী হয়ে আসছেন সে কারণে গ্রাহকের কাছে টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগে বলা হয়েছে। এ দিকে পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ৮ হাজার (মেগাওয়াট)। পাচ্ছে তারা ৮ হাজার (মেগাওয়াট)। সে কারণে তাদের লোডশেডিং থাকার কথা নয়। অথচ সব এলাকা ঘন ঘন লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) মো. সেলিম উদ্দিন ফোনো কোনো বক্তব্য দিবেন না বলে জানান।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার দিনের সর্বোচ্চ সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদার ১২৫০০-এবং সন্ধায় ১৪২০০ (মেগাওয়াট) গত সোমবার ছিল প্রকৃত উৎপাদন দুপুরে ১১৪৪৯ এবং বিকালে ১৩৪৫৬ (মেগাওয়াট)।
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের চাহিদার যেমত সরবরাহ তেমন। এখন কোনো লোডশেডিং নেই। গ্রামে তাদের লাইনগুলো অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে গাছপালার সংখ্যাও বেশি। তাই ঝড়-বৃষ্টি হলে গাছপালা ভেঙে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় কর্মকর্তারা নিজেরাও সম্পদ রক্ষায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখেন। দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকার চেয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি না ঘটে।
গত মে মাসে সর্বোচ্চ চাহিদা ৯ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। একই সময়ে সরবরাহ করা হয়েছে ৮ হাজার ৭৬৬ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ১ হাজার ৭৮৪ মেগাওয়াট। গত বছর একই দিনে আরইবি লোডশেডিং করেছে মাত্র ১৩৩ মেগাওয়াট। গত সর্বোচ্চ দুই হাজার ২২৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে আরইবি। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে রাজধানীর কাছের সাভার এলাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর বেশি লোডশেডিং হয়েছে রাজশাহী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে। ঢাকা বিভাগে লোডশেডিং ছিল সাভারে। আর অনেক অঞ্চলে কোথাও তেমন লোডশেডিং করা হয়নি। চলমান তাপপ্রবাহের কারণে দিন ও রাতে গরমের অনুভূতি আলাদা করার উপায় নেই। গভীর রাত পর্যন্ত থাকছে গরমের তেজ। গত কয়েক দিন সর্বোচ্চ লোডশেডিং হচ্ছে মধ্যরাতের পর। এই পরিস্থিতি বিশেষ করে ঢাকার বাইরে সাভারের আশুলিয়ায় বেশি বলে জানান শ্রীপুর জোনাল অফিস ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. ইউসুফ আলী।
সাভার লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা বলেন, রাতে ঘুমাতে গেলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসে। ঘুম কিছুটা গভীর হওয়ার আগে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর আধা ঘণ্টা কিংবা এক ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। গত কয়েকদিন ধরে এমন চলছে। ঘুমাতে পারছে না কেউ। বাচ্চাদের সকালে স্কুলে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আর দিনের বেলায় ঘন্টায় ঘন্টায় যাচ্ছে বিদ্যুৎ। পল্লী বিদ্যুতের কর্মকর্তারা লোডশেডিং করে অন্যদিকে বাজিন্য করেন।
বিদ্যুতের এমন ভেল্কিবাজিতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতেও পারছেন না। দিনে বিদ্যুৎ থাকে না ভ্যাপসা গরমে ঘরে টেকাও যায়না। শুধু তাই নয়, ব্যাপক লোডশেডিং এর কারণে কল কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। হাট বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও কমে গেছে। ঘনঘন লোডশেডিং এবং প্রচন্ড দাবদাহের কারণে পারতপক্ষে মানুষজন ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
জিরানীর গোহাইলবাড়ি এলাকার বাসিন্দা হাফিজুর রহমানসহ অনেকেই জানান, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে বিদ্যুৎ গেছে দুপুর দুইটা পর্যন্ত আসে নাই। আবার রাতেও ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। এই ভেপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছে জনজীবন। জিরানী এলাকার পোশাক শ্রমিক সুলতান আহম্মেদ বলেন, তারা টাকা দিয়ে বদলী হয়েছে এসেছেন। সেকারণে ঘুষ নিচ্ছেন। ঘন ঘন লোড শেডিংএ আমরা অতিষ্ঠ। অফিসে বিদ্যুৎ না থাকলে কাজ বন্ধ। বাড়িতেও গরমে টেকা দায়। মাঝে মাঝে হঠাৎ স্বস্থির বৃষ্টি নামলেও বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর শুরু হয় ভেপসা গরম। আবার এরমধ্যে থাকে না বিদ্যুৎ। সবমিলিয়ে আমাদের জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পরেছে বলেন এই পোশাক কর্মী।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জিরানী সাব-জোনাল অফিসের এজিএম (ওএন্ডএম) মো. আ: বাতেন বলেন, হঠাৎ কবিরপুর গ্রীডে প্রব্লেম হওয়ার কারনে সকাল থেকে জিরানীসহ আশপাশ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এরকম কখন হয়নি। এজন্য আমরা দুঃখিত। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক হয়ে যাবে।
এদিকে অনেক শিল্পমালিকরাও বলেছেন, বিদ্যুতের কারনে একবার কারখানা বন্ধ হলে পুরো কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যায়। নতুন করে ফ্যাক্টরি চালু করতে আরও ৩-৪ ঘণ্টা সময় লাগে। এ অবস্থায় ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শিল্প কারখানার একাধিক কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, বড় বড় শিল্প কারখানাগুলো বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখে। কিন্তু ছোট ছোট কারখানাগুলোর পক্ষে বাড়তি টাকা খরচ করে জেনারেট চালানো সম্ভব নয়, তাই উৎপাদনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের।
ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর ডিজিএম (কারিগরি) প্রকৌশলী মোহাম্মদ আব্দুল জলিল মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের এখন বিদ্যুতের কোন ঘাটতি নাই। যা প্রয়োজন তাই আছে। তবে জিরানী এলাকায় সকাল থেকে বিদ্যুৎ না থাকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কবীরপুর গ্রীড থেকে নয়ারহাট পর্যন্ত ৩৩ কেবির লাইনের একটি ক্লাম পুড়ে যায় সেটি ঠিক করার মুহুর্তে হঠাৎ ঝড় শুরু হলে তার ছিড়ে পরে যা মেরামতে কিছুটা সময় লাগছে। এজন্য ওই এলাকায় বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ রয়েছে। দুপুর ২টায় এই রিপোর্ট লখার সময় পর্যন্ত তিনি বলেন, আর এক ঘন্টার মধ্যে বিদ্যুতের সমস্যা সমাধান হবে।
আরইবি সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৬১ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ৮০টি, অনুমোদিত প্রকল্প ৮৪টি, অন্তর্ভুক্ত জেলা ৬১টি, অন্তর্ভুক্ত উপজেলা ৪৬২ টি (৪৬১টি অন-গ্রিড এবং ০১ অফ-গ্রিড), শতভাগ বিদ্যুতায়িত উপজেলা ৪৬২টি, বিদ্যুতায়িত গ্রাম ৮৫ হাজার ৩৩৭টি, মোট নির্মিত লাইন ৫,৮০,৭২৬ কি.মি, মোট বিদ্যুতায়িত লাইন, ৫,৬৪,৫৫৭ কি.মি, ৩৩/১১ কে.ভি. সাব-স্টেশনের সংখ্যা এবং ক্ষমতা ১২৯৯ টি এবং ১৭,৪৭০ গঠন। সিস্টেম লস ৯ দশমিক ০১ শতাংশ মাসিক বিক্রয় ৩১৩১ কোটি টাকা, বিল সংগ্রহ ৯৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ সর্বোচ্চ চাহিদা ৯৮০১ মেগাওয়াট।