আসন্ন ঈদুল আজহায় কমবেশি সোয়া কোটি পিস কুরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ হবে-এ হিসাব বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ)। বিপুলসংখ্যক এই চামড়ার মধ্যে একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচারের শঙ্কায় ভুগছেন ট্যানারি শিল্পের উদ্যোক্তারা। চামড়া পাচার হতে পারে-এমন ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ রুট চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সীমান্ত পথে ১২টি এবং রাজধানীসহ ঢাকার আশপাশ এলাকায় সাতটি।
সম্প্রতি এ তালিকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, চামড়ার বাজারের সিন্ডিকেট ও পাচার প্রতিরোধে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়েছে। খুব শিগগিরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো যৌথভাবে আরও একটি বৈঠক করবে। সেখান থেকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেছেন, চামড়া পাচার রোধে এবং চামড়া যেন সীমান্ত অভিমুখে যেতে না পারে, সে ব্যবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগে থেকে করবে। চামড়া বাজার ঘিরে কোনো ধরনের সিন্ডিকেট সৃষ্টি করতে দেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে বিটিএ চেয়ারম্যান মো. শাহীন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও চামড়া পাচারের আশঙ্কা থাকছে। আমরা স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে পাচার হতে পারে-এমন সীমান্তগুলো চিহ্নিত করে দিয়েছি। পাচার প্রতিরোধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজে লাগাতে বলেছি। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকা দিয়ে যাতে কোনো চামড়া পাচার না হয় সেজন্য মাসব্যাপী নজরদারি করতে বলা হয়েছে।
সারা বছরের পশুর চামড়ার মোট সংগ্রহের ৫০ শতাংশ আসে কুরবানি থেকে। বিটিএ’র হিসাবে আসন্ন কুরবানিতে কমপক্ষে ১ কোটি ২৫ লাখ পিস পশুর চামড়া সংগ্রহ হবে। এরমধ্যে আছে প্রায় এক কোটি গরু ও মহিষ এবং ২৫ লাখ ছাগল ও ভেড়া। এই চামড়া বাজার ঘিরে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা টার্নওভার হবে।
সূত্রমতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দাখিল করা কুরবানির চামড়া পাচারের ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত রুটের তালিকার মধ্যে রয়েছে-বেনাপোল, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, জীবননগর, মেহেরপুর, দর্শনা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, জাফলং, তামাবিল, করিমগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন সীমান্তপথ।
ট্যানারি মালিকদের দেওয়া তথ্যমতে-যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাটকলঘাট, কালীগঞ্জ, নড়াইল ও রাজারহাট এলাকার কুরবানির চামড়া সাধারণত পাচার হয় বেনাপোল, কলারোয়া ও সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে। এখানে চামড়ার বড় হাট বসে যশোর রাজারহাটে। বছরের সাধারণ সময়ে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার এখানে পশুর চামড়ার হাট বসে। আর কুরবানির সময় আশপাশ অঞ্চলের চামড়া এ হাটেই কেনাবেচা হয়। ফলে এই সীমান্তগুলোর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
এছাড়া ঝিনাইদহ, মাগুড়া, শৈলকুপা, কোটচাঁদপুর ও মহেশপুরের চামড়া পাচার হয়ে থাকে জীবননগর সীমান্ত দিয়ে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ ও রাজশাহীর গোদাগাড়ী সীমান্ত পথ দিয়ে পাচার হয় নাটোর হাটের চামড়া। দেশের চামড়ার মোট চাহিদার ২৫ শতাংশ আসে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্যায়ের নাটোরের চকবৈদ্যনাথ চামড়ার আড়ত থেকে। প্রতি শুক্র ও শনিবার এই হাটে চামড়া বেচাকেনা হয়। ইতোমধ্যে কুরবানিকে সামনে রেখে আড়ত ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চামড়ার মান ভালো বলে অধিকাংশ ট্যানারির মালিকদের চোখ থাকে এই বাজারের দিকে। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে পাচার সহজ বলে নজর থাকে পাচারকারীদেরও। এই হাটের অন্যান্য ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি পুরোপুরি নিয়েছেন বলে জানান নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শহিদুল ইসলাম।
সূত্র আরও জানায়-চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, আল্লাহ দরগা, দৌলতপুর ও আলমডাঙ্গার চামড়া পাচারের রুট হচ্ছে মেহেরপুর ও দর্শনা সীমান্ত পয়েন্ট। এই দুটি পয়েন্টকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সিলেট ও মৌলভীবাজার অঞ্চলের কুরবানির চামড়া পাচারের জন্য জাফলং, তামাবিল ও করিমগঞ্জ সীমান্ত পথকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে শনাক্ত করা হয়। আর দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন সীমান্ত পথ দিয়ে চামড়া পাচারের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশ এলাকা বিপুলসংখ্যক পশু জবাই হয় কুরবানিতে। ঢাকার চামড়া পাচার করতে সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে তারা সাতটি রুট ব্যবহার করে। এগুলো হচ্ছে-সাভার, গাজীপুর চৌরাস্তা, কাঁচপুর ব্রিজ, আশুলিয়া, বুড়িগঙ্গা ব্রিজ ১ ও ২ ও সিংগাইর ব্রিজ। চামড়া পাচার রোধে ঈদুল আজহার দিন থেকে পরবর্তী সাত দিন পর্যন্ত ঢাকা থেকে চামড়া ভর্তি ট্রাক ঢাকার বাইরে না যেতে পারে-সে জন্য চিহ্নিত পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানোর প্রস্তাব করেছে বিটিএ ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন।
২৯ জুন ঈদুল আজহা। এরই মধ্যে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছেন চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত পুরান ঢাকার পোস্তার আড়ত মালিকরা। জানতে চাইলে আড়তদার মালিক সমিতি বাংলাদেশ হাই অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান যুগান্তরকে বলেন, ট্যানারির মালিকদের কাছে ১২০ কোটি টাকা বকেয়া আছে। এই টাকা পাওয়া গেলে এবার ব্যবসায় কোনো সমস্যা হবে না। পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাচার প্রতিরোধে আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার পদক্ষেপ নিলে এ বছরও প্রতিরোধ সম্ভব। তার মতে, চামড়া পাচার বিচ্ছিন্নভাবে হয়। তবে আগ থেকে অনেক নিয়ন্ত্রণে আসছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) ভূমিকার কারণে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে-গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, নওগার মাতাজি, কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ, টাংগাইল পাকুটিয়া, ময়নসিংহের হালুয়া ঘাট ও শম্ভুগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ঢাকার টঙ্গী এবং আমিন বাজারে চামড়ার বড় হাটগুলো সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে। এসব বাজার থেকে চামড়াভর্তি ট্রাক বা অন্যান্য পরিবহণ সীমান্তের দিকে যেতে না পারে তার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ব্যবস্থা নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।