দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে আন্দোলন চলমান তাকে ‘বিদেশী হস্তক্ষেপ’ নামের পাল্টা ইস্যু জিইয়ে রেখে সেই আন্দোলনকে চাপা দিতে চেষ্টা করছে সরকারি জোটের নেতৃবৃন্দ। তারা নির্বাচন পক্ষপাতমুক্ত হওয়ার পক্ষে কথা না বলে কথিত বিদেশী হস্তক্ষেপের ধুয়া তুলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সাম্প্রতিক মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার বহু আগে থেকেই সরকারবিরোধীরা একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছে। সেই প্রত্যাশিত সরকারের নাম তত্ত্বাবধায়ক হোক বা নির্দলীয় অথবা নিরপেক্ষÑ যে নামেই হোক সেটি প্রতিষ্ঠার জন্য সেই ২০১২-১৩ সাল থেকেই বিভিন্নভাবে কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ, আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই কর্মসূচি নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকারকে কেন্দ্র করে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে। তার কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া হলেও সেটি আগামী নির্বাচনে কতোটা প্রভাব ফেলতে পারবে তা নিশ্চিত নয়। তবে নির্বাচনী ইস্যুতে বিরোধীপক্ষের দাবি জনমনে ব্যাপক আলোড়ন তুলতে সমর্থ হয়। এমতাবস্থায় সরকারি জোটের নেতৃবৃন্দ একে পাশ কাটাতে বিদেশী হস্তক্ষেপ ইস্যু সৃষ্টি করে তার পক্ষে মাঠ গরমের চেষ্টা করছেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
মেনন ও ইনুর মন্তব্য : এতোদিন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ এই ইস্যুতে কিছতা ভারসাম্যমূলক বক্তব্য দিয়ে আসলেও এখন তাদের শরিক দলের নেতৃবৃন্দও মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে পথ অনুসন্ধানের কথা না বলে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের অনুসারী দেশগুলোর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। এর মধ্যে সরকারের অন্যতম বাম শরিক ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন সম্প্রতি জাতীয় সংসদে দেয়া বক্তৃতায় দাবি করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়, কোয়াডে বাংলাদেশকে চায়। বর্তমান সরকারকে হটানোর লক্ষ্যে তারা সব কিছু করছে। তিনি আরো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যারা বন্ধু, তাদের শত্রুর প্রয়োজন নেই। বেশকিছু সময় আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাগে রাখতে স্যাংশন দিয়েছে। এখন নির্বাচনকে উপলক্ষ করে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে।’
তবে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস। দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা একটি জাতীয় দৈনিককে জানান, “যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ শক্তিশালী ও সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব বজায় রাখে। আমরা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। দেশটির কোনো ভূখ-ের ওপর আমরা কোনো দাবি করিনি। নিরাপদ ও সুরক্ষিত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বকে আমরা মূল্য দিই এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনসহ গণতন্ত্রের প্রচারে একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করি।”
‘ভারতকে ডমিনেট করতে বাংলাদেশকে খেলার মাঠ বানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র’ বলে জাতীয় সংসদে মন্তব্য করেন সরকারের আরেক বাম শরিক জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন ইনু। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র আসলে ভারতকে ‘ডমিনেট’ করতে (কর্তৃত্ব খাটাতে) বাংলাদেশকে খেলার মাঠ বানাতে চাচ্ছে। দিল্লিকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি পাশে না পেলে ভারতের বন্ধুদেশ বাংলাদেশ মানে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাদের পছন্দের পুতুল কাউকে ক্ষমতায় বসাতে চেষ্টা করবে। ইনু বলেন, ‘হঠাৎ আমেরিকার এতো উৎসাহ কেন? তারা গণতন্ত্র টার্ম ইউজ করছে। অথচ পৃথিবীতে এমন একটি দেশের নাম কেউ বলতে পারবে না, যেখানে আমেরিকা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। বরং আমেরিকা যখন কোনো দেশের গণতন্ত্রের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে ওঠে, তখন সেই দেশের সরকার বা বিরোধী দলের চেয়ে জনগণের জন্য বেশি দুর্ভোগ বয়ে আনে।’ ইনু বলেন, ‘আমাদের এখন ভাবার সময় এসেছে আমেরিকার হঠাৎ এই অতি উৎসাহের হেতু কী? গণতন্ত্র নাকি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ?’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিরোধীদের এতোদিনের ‘নিরপেক্ষ নির্বাচন’ দাবির বিরুদ্ধে এই শরিকেরা কোনো বক্তব্য দেননি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিগত নির্বাচন যে একতরফা ও পক্ষপাতমূলক হয়েছে তার সাক্ষ্যও দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন এগিয়ে আসায় এবং দেশে-বিদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি উচ্চকিত হওয়ায় এই শরিকদের ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক পেয়ে বসেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশসমূহ। তাদের বিভিন্ন উদ্যোগ সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তবে বামপন্থী শরিকরা এতোদিন পর্যবেক্ষণে থাকলেও একদা তাদের আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষক চীন ও রাশিয়া বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের অবস্থানের পক্ষে থাকার ঘোষণা দেয়ার পর তারা চাঙা হয়ে উঠেছেন বলে মনে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
পর্যবেক্ষকদের অভিমত: একজন পর্যবেক্ষক অভিমত প্রকাশ করেছেন, প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, এরপর কংগ্রেসম্যান ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যদের চিঠিÑ এসব ঘটনায় সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করেছে চীন। দেশটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন জানিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছে। চীনের এমন অবস্থানে দেশটির প্রতি বাংলাদেশ আরো বেশি ঝুঁকে পড়ছে কি নাÑ এমন আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে সরকারকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে। চীন ও ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করেই পরিস্থিতি সামলাতে চাচ্ছে সরকার। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমানোর লক্ষ্যে সরকার নিজে থেকেও নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ কমাতে আওয়ামী লীগ সরকার কংগ্রেসম্যানদের চিঠির অভিযোগের জবাব দেয়াসহ বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছে। এই তৎপরতার পাশাপাশি ভারতের ওপরও নির্ভর করছে সরকার।
অপর একজন সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের নেতারা অবিরাম বলে যাচ্ছেন যে বর্তমান সরকারের অধীন আগামী নির্বাচন হবে অবাধ ও স্বচ্ছ এবং জনগণ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে যেভাবে নির্বাচন হয়, বাংলাদেশেও সেভাবেই হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, সাধারণ জনগণ এবং প্রকৃত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই আশ্বস্ত হতে পারছে না যে আগামী নির্বাচন ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো হবে না। আলোচনা বা আইন পরিবর্তনÑ যেভাবেই হোক এ বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে পারলেই সমস্যার সমাধান হতে পারতো। কিন্তু নির্বাচনে ‘নিশ্চিত বিজয়’ অর্জনের একটি ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় সরকারই বা কেনো তা করতে যাবে?