চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে নতুন রোগী। এতে হাসপাতালেও রোগীর চাপ বাড়ছে। রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩টি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নির্ধারিত শয্যার চেয়েও অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটিতে চিকিৎসার জন্য আসা যত রোগী ভর্তি হয়েছে তার অধিকাংশই যাত্রাবাড়ী, কাজলা, মানিকনগর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার।
রোগীরা জানান, তাদের এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি হলেই পানি জমে। কিছু এলাকায় সবসময় পানি জমে থাকে। এতে মশার উপদ্রব বেড়ে গিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন অনেকে।
মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এখনো যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে বেশি ডেঙ্গু রোগী আসছে। তবে এখন তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। কাজলা, দনিয়া, ধলপুর, বনশ্রী, রামপুরা, মান্ডা, মুগদা, সবুজবাগ, মতিঝিলসহ ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসছে।
এই মুহূর্তে হাসপাতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুরের রোগী ভর্তি রয়েছে মুগদা হাসপাতালটিতে। এই হাসপাতালে ২৭৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। পুরুষ ওয়ার্ডে ১৬৭ জন আর শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছে ৭৬ জন। গত এক সপ্তাহে এই গতি ঊর্ধ্বমুখী।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, গত মে মাসে মোট ৩০৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। তবে চলতি জুনের প্রথম ১৮ দিনেই ৯০৯ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। এটা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এরমধ্যে সব বয়সের রোগীই রয়েছে। শিশু রোগীর সংখ্যা ২৫ শতাংশ। এবারের ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গেও ভিন্নতা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। তাদের ক্ষেত্রে জ্বরের লক্ষণ তেমন দেখা যাচ্ছে না। তবে ক্রিটিক্যাল ফেসের ডেঙ্গু রোগী বেশি আসছে। তখন কারও ব্লাড পেশার কমে যাচ্ছে, প্লাটিলেট দ্রুত নেমে যাচ্ছে। কারও শারীরে পানি জমে গেছে কিংবা কারও প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা হচ্ছে।
সরজমিন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, ধলপুর ও কাজলাসহ আশেপাশের এলাকা ঘুরে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির যেন স্বর্গরাজ্য বলে মনে হয়েছে। এসব এলাকায় যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। বিভিন্ন রাস্তার খানাখন্দে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। ময়লার স্তূপে পড়ে থাকা পলিথিন, বোতল, ডাবের খোসা, টায়ারসহ বিভিন্ন বস্তুতে পানি জমে থাকে। ডোবা, নিচু রাস্তা কিংবা ঢালু জমিতেও পানি জমে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির উপদ্রব দেখা গেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, তাদের এলাকায় দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। ধলপুরে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বসবাসের জন্য দয়াগঞ্জ ও ধলপুরে নির্মিত ১০ তলাবিশিষ্ট আবাসিন ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। সেখানে বিশাল জায়গাজুড়ে বৃষ্টির পানি আটকে আছে। এই পানিতে এডিশ মশার বংশবিস্তার হওয়ার আতঙ্কেও রয়েছেন এলাকাবাসী। তাই এসব পানি দ্রুত নিষ্কাশন করার অনুরোধও জানান তারা।
ধলপুরের বাদল সর্দার রোড সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের এদিকে অনেক মশা। দিনে-রাতে সবসময় মশা কামড়ায়। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশন থেকে এসে ওষুধ দিয়ে যায়। ময়লা আবর্জনা আর পানি জমে থাকার জন্য মশাও বেশি। এদিকে সব সময় পানি থাকে। বৃষ্টি হলে পানি বেড়ে যায়। গত বছর আমার ছেলের ডেঙ্গু হয়েছে। নুর আলম নামের এক শ্রমজীবী বলেন, এখন ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ। হাসপাতালেও বেড খালি পাওয়া যায় না। সিটি করপোরেশনের এই নিচু জায়গাগুলো ভালোমতো দেখা উচিত। এখানে ময়লা-আবর্জনা থাকার কারণে পানি জমে মশা বেশি হয়। রাতে অনেক মশা কামড়ায়, দিনেও মশা কামড়ায়। আমাদের এদিকে এখন প্রতিটা বাসায় ডেঙ্গু নিয়ে চিন্তিত।
সম্প্রতি ডেঙ্গু আক্রন্ত হয়ে মুগদা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন কাজলার হাজী আবুল কালাম নগর এলাকার বাসিন্দা হাসান আলী। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে এখানে খাল পরিষ্কার করছিল। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। তখন মশার কামড় টের পাই। সেদিন বিকালেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। চোখ ব্যথা করছিল। পরে ডাক্তার দেখানোর পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। আমাদের এদিকে অনেকের ডেঙ্গু হয়েছে। কিছুদিন আগে একজন মারা গেছে। রাস্তায় হাঁটলে অনেকের কাছে শোনা যায়।
কাজলা এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৬৩নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম খান মানবজমিনকে বলেন, কাজলা একটা বর্ধিষ্ণু এলাকা। এখানে মানুষের বাড়ি আছে তার পাশেই জমি আছে। জমির মধ্যে পানি জমে থাকে। সেখানে এডিস মশার অসংখ্য লার্ভা। আমি ৯টা বাড়ি সিলগালা করেছি। আমরা সহনশীল রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ডেঙ্গু বেড়েই চলছে। আমার জনবল সংকটের কারণে পুরো এলাকায় ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এলাকার মানুষ সচেতন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাড়ির আশপাশও মানুষ পরিষ্কার রাখে না। ফুলের টবে পানি জমে থাকে। ভাঙা বালতি, টায়ার, খানাখন্দের মধ্যে পানি জমে থাকে। এ ছাড়া কাজলা ডাম্পিং এলাকার কারণে আমরা ময়লা পরিষ্কার করেও কুলাতে পারি না। তাও আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ডেঙ্গু সামনে আরও বাড়তে পারে।
একদিনে ডেঙ্গুতে ৩০৫ রোগী ভর্তি, একজনের মৃত্যু দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই এবছরে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩০৫ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৮ জনে। একদিনে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। জুন মাসে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৪ জনে। গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩০৫ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৩২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৭৩ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৩০৫ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৪৮ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৯০৮ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৩ হাজার ৭৫৬ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ২ হাজার ৮৮৬ জন এবং মারা গেছেন ২১ জন।