মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে বাজারে টাকার জোগানে আরও লাগাম টানছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসাবে নীতি সুদহার আরও একদফা বাড়ানো হয়েছে। কমানো হয়েছে মোট অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা। বাড়ানো হয়েছে সরকারি খাতে ঋণ বিতরণ। প্রত্যাহার করা হয়েছে ঋণের সুদের ৯ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা। আরোপ করা হয়েছে নতুন সুদহার নীতি। এতে সুদের হার বেড়ে সোয়া ১০ থেকে ১২ শতাংশে উঠে যাবে। বাড়বে আমানতের সুদহারও। ডলারের একক ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করায় বাড়বে ডলারের দামও। আইএমএফ-এর মানদণ্ড অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নিট হিসাব করা হবে। এতে রিজার্ভ কমে যাবে। ১ জুলাই থেকে এসব পদ্ধতি কার্যকর হবে।
আগামী অর্থবছরের জন্য এসব পরিবর্তন এনে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোববার ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে আগামী অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এর গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেন ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এ সময় ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামালসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মুদ্রানীতিতে আইএমএফ-এর শর্ত হিসাবে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ৯ শতাংশ তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী ঋণের সুদের হারকে একেবারে বাজারভিত্তিক করেনি। একটি সুদহার করিডর আরোপ করে সীমার মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহারের ভিত্তিতে ঠিক হবে রেফারেন্স রেট। এর সঙ্গে ব্যাংক সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ যোগ করে ঋণের সুদ আরোপ করবে। বর্তমানে ওই বিলের সুদহার ৭ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশে ওঠানামা করছে। কখনো এর হার বেড়ে ৮ শতাংশের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। গড়ে সোয়া ৭ শতাংশ সুদ হলে এর সঙ্গে ব্যাংক ৩ শতাংশ যোগ করে সুদ নির্ধারণ করবে সোয়া ১০ শতাংশ। কখনো এটি সাড়ে ১০ শতাংশও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুদহার হবে সোয়া ১২ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত এবং ভোক্তা ঋণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাড়তি খরচ মেটাতে আরও ১ শতাংশ যোগ করতে পারবে। ফলে এসব খাতে সুদ সোয়া ১১ থেকে সোয়া ১৩ শতাংশ বা আরও বেশি হবে।
বাজারে টাকার প্রবাহে লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার বা রেপো (ট্রেজারি বিল পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এতে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়ার খরচ বাড়বে। ফলে ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হবে। একই সঙ্গে রিভার্স রেপো হার ৪ দশমিক ২৫ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলেঅ অতিরিক্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়। রেপো ও রিভার্স রেপোর এই নতুন হার ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে।
ঋণের সর্বোচ্চ সীমা নিয়ে ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ৯ শতাংশ সুদের সীমা উঠানো হয়নি বরং এক শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। আইএমএফ-এর শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করা। সেক্ষেত্রে আইএমএফ-এর সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হবে যে এটা বাজারভিত্তিক হয় কি না। কেননা তাদের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আসবে আগামী দিনে।
তিনি আরও বলেন, গত ৬ মাসের বেরসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জিত হয়নি, এ কারণেই হয়তো কমানো হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটু বেশি কমিয়েছে এবার। কারণ, দেশের বিনিয়োগ হয় ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। নতুন বিনিয়োগ মানেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি। লক্ষ্যমাত্রা কমানোর ফলে এটা বিঘ্নিত হতে পারে। বিনিয়োগের অগ্রগতি স্তিমিত হয়ে যেতে পারে। নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে কর্মসংস্থানে। সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বেশি নিচ্ছে। সেই লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। এতে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ঘোষিত মুদ্রানীতি পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। কারণ বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরকারকে বেশি ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেসরকারি খাত। কারণ কর্মসংস্থান তৈরি না হলে দেশের উৎপাদন বাড়বে না। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বৃদ্ধি পাবে। এরকম মুদ্রানীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উদ্যোক্তারা।
মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব আইএমএফ’র মানদণ্ড অনুযায়ী প্রকাশ করার পাশাপাশি নিজস্ব হিসাব প্রকাশ করার কথাও জানিয়েছে। এতে গ্রস রিজার্ভ বেশি থাকলেও নিট রিজার্ভ কমে যাবে। কারণ রিজার্ভ থেকে বিভিন্ন তহবিলে বরাদ্দ অর্থ নিট হিসাব থেকে বাদ দিতে হবে। এখন পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে প্রায় ৫৫০ কোটি ডলার বিভিন্ন তহবিলে বিনিয়োগ করা আছে। এ বিনিয়োগ কমানো হচ্ছে। ফলে রিজার্ভ থেকে বাদ দেওয়া অর্থের পরিমাণ কমে যাবে।
আইএমএফ’র পরামর্শ অনুযায়ী মুদ্রানীতিতে ডলারের একক ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করার কথা ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের একক ও বাজারভিত্তিক দর কার্যকর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এ লক্ষ্যে কাজ করছে।
সূত্র জানায়, এই দর কার্যকর হলে বাজারে ডলারের দাম আরও বেড়ে যাবে। মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখতে রিজার্ভ থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বাজারে বিক্রি করছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘ঘোষিত মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট নিরসনে খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে না। কারণ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।’
এদিকে প্রশ্নোত্তর পর্বে গভর্নর বলেন, এবারের মুদ্রানীতি ‘কন্ট্রাকশনারি ও টাইট’ ভঙ্গির। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর বলেন, আইএমএফ’র আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব করার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব পদ্ধতিতেও হিসাব করা হবে। তবে বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভের তথ্য হিসাব করলেও তা প্রকাশ করা হবে না। পৃথিবীর কোনো দেশ তা প্রকাশ করে না। এ বিষয়ে আইএমএফ’রও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবই প্রকাশ করা হবে। সূত্র জানায়, আইএমএফ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করতে বলেছিল।
তবে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি খাতের ঋণ বাড়লেও জুনের মধ্যে তা কমে যাবে। চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত তা ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ এবং আগামী জুন পর্যন্ত ১৫.৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা চলতি অর্থবছরে ছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এ খাতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তবে আগামী জুন পর্যন্ত তা কমিয়ে ৩০ শতাংশ নামিয়ে আনা হবে। বেসরকারি খাতে চলতি অর্থবছরের ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। বাড়তে পারে ১১ শতাংশ পর্যন্ত। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে তা ১০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জুনের মধ্যে ১১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সূত্র জানায়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমানোর কারণে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। একই সঙ্গে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর ফলে বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাবে কম।
এদিকে আন্তর্জাতিক ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দেওয়ার প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘আমার মতে মুডিসের এই কাজটি ভূ-রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি আমাদের অর্থনীতি ক্রমেই সবল হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু আগের চেয়ে দুর্বল হয়নি।’