দেশে ডেঙ্গু এবং করোনা আবার আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই ভীতিকর দুটি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। যদিও ডেঙ্গু আক্রান্তের মৌসুম এখনও আসেনি। আর করোনাতো বৈশ্বয়িক সমস্যা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অসময়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তারা বলছেন লক্ষণ ভাল না। এদিকে কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু তাদের এসব প্রচেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে না।
গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে একজন মারা গেছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট ৩৪ জনের মৃত্যু হলো। এছাড়া গত এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩০৫ জন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৩২ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৩ জন। রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে সারা দেশে সর্বমোট এক হাজার ১১৮ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৭০ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ২শ’৪৮ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এবার বৃষ্টির ধরনটাই একটু আলাদা। গত মে মাসের শেষ দিকে সারাদেশেই, বিশেষ করে ঢাকা শহরে বেশ বৃষ্টিপাত হয়ে গেছে। এরপর প্রায় ১০ দিনে আর বৃষ্টি হয়নি। এই সময়ের মধ্যে ডেঙ্গুর ডিম থেকে লার্ভা হয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক মশা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া ঢাকা শহরে বৃষ্টি ছাড়াও প্রচুর নির্মাণ কাজ হচ্ছে। নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে একনাগাড়ে অনেক দিন পানি আটকে থাকে। সেখানে এডিস মশা প্রতিনিয়তই ডিম ছেড়ে বংশ বৃদ্ধি করতে পারছে। মূলত নির্মাণাধীন ভবন থেকে মশার বংশ অবাধে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এবার ঢাকা শহরে ডেঙ্গু বৃদ্ধি পেয়েছে পুরো মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার মনে করেন, বাংলাদেশে নবেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত একদমই বৃষ্টিপাত থাকে না। আমরা বার বার বলে এসেছি যে, বৃষ্টির সঙ্গে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার একটি সম্পর্ক থাকলেও এখন আর সেটি নেই। ডেঙ্গু এখন আর মৌসম বুঝে হবে না, এটি সারা বছরই বাংলাদেশে থাকবে। বহুতল ভবনগুলোতে পার্কিং স্পেস তৈরি করা হয়েছে। পার্কিংয়ের এই জায়গাতে গাড়ি ধোয়া-মোছা করা হয়। সেখানে যে পানি জমে তাতে আমরা এডিস মশার লার্ভা পাই।
ডেঙ্গু হওয়ার তিন থেকে সাত দিন এর তীব্র লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, তীব্র পেট ব্যথা, ক্রমাগত বমি করা, বমির সঙ্গে রক্ত যাওয়া, ঘন ঘন শ্বাস নেয়া এবং শরীরে অবসাদ বোধ করা ও অস্থিরতা বোধ করা।
মশার প্রজনন রোধে কয়েকটি কাজ করার পরামর্শও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এগুলো হলো- ঘর ও আশেপাশে যেকোনো পাত্রে বা জায়গায় জমে থাকা পানি তিনদিন পরপর ফেলে দিলে এডিস মশার লার্ভা মরে যাবে, ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে এবং ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা বা নারিকেলের মালা, কন্টেইনার, মটকা, ব্যাটারি সেল ইত্যাদিতে এডিস মশা ডিম পাড়ে বিধায় এগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে।
এছাড়াও পানি যাতে না জমে সেজন্য অব্যবহৃত পানির পাত্র ধ্বংস করতে হবে অথবা উল্টে রাখতে হবে, দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে এবং ডেঙ্গু হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত যোগাযোগ করার পরামর্শও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
এদিকে গত একদিনে দেশে আরও ২৩০ জন মানুষের করোনা শনাক্ত হয়েছে; এ সময়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, রোববার সকাল পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ২৯৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ওই ২৩০ রোগী শনাক্ত হয়। এতে দিনে শনাক্তের হার হয়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ; আগের দিনে শনাক্তের হার ছিল ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে মোট শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা হয়েছে ২০ লাখ ৪১ হাজার ৪৭০ জন। মৃতের মোট সংখ্যা বেড়ে ২৯ হাজার ৪৫৭ জন হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৭ জন কোভিড রোগী সেরে উঠেছেন; তাদের নিয়ে এ পর্যন্ত সুস্থ হলেন ২০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৬ জন। গত একদিনে শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ২১৮ জনই ঢাকার। এর বাইরে সিলেটে ৪ জন, ময়মনসিংহে ২ জন এবং ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বগুড়া ও ভোলায় একজন করে রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়েছিল ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই দেশে রেকর্ড ১৬ হাজার ২৩০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ২০২০ সালের ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০২১ সালের ৫ ও ১০ অগাস্ট ২৬৪ জন করে মৃত্যুর খবর আসে, যা মহামারির মধ্যে এক দিনের সর্বোচ্চ সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মোট চার হাজার ৯০৮ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় তিন হাজার ৮০৭ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে এক হাজার ১০১ জন ভর্তি হয়েছেন।
একই সময়ে সারা দেশে সর্বমোট ছাড়প্রাপ্ত ডেঙ্গুরোগী তিন হাজার ৭৫৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগী দুই হাজার ৯১০ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ৮৪৬ জন। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৮১ জন মারা যান।