বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার মতো গ্যাস নেই পেট্রোবাংলার কাছে। আমদানিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভর করেই উৎপাদন হচ্ছে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। এর ওপর গ্যাস চালিত আরও চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। গ্যাসের তীব্র সংকটের মধ্যে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র কিভাবে উৎপাদনে যাবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে এখন গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১০০০ মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের অভাবে এসব কেন্দ্র থেকে ৬৫০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। এলএনজি সরবরাহ কমে গেলে উৎপাদনও কমে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্র জানায়, সামিট পাওয়ার মেঘনা ঘাটে ৫৮৩ মেগাওয়াট, ইউনিক পাওয়ার ৬০০ মেগাওয়াট ও ভারতীয় রিলায়েন্স পাওয়ার ৭১৮ মেগাওয়াটের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। চলতি বছরের মার্চে বিদ্যুৎকেন্দ্র তিনটির উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনও এগুলো নির্মাণাধীন।
এ ছাড়া খুলনার রূপসায় নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড (এনডব্লিউপিজিসিএল) ৮০০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এই কেন্দ্রটির জ্বালানিও এলএনজি বা গ্যাস। কেন্দ্রটির ৪০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটের চলতি বছর অক্টোবরে ও সমান ক্ষমতার দ্বিতীয় ইউনিটের আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ময়মনসিংহে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) নির্মাণ করছে ৩৬০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০২৫ সালের মধ্যে দুটি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদনে আসার পরিকল্পনা করেছে পিডিবি। যার একটি হরিপুর ২৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি উৎপাদনে আসবে ২০২৫ সালের জুনে। অন্য কেন্দ্রটি রাউজানের ৪০০ মেগাওয়াট। এসব স্থানে আগে থেকেই পিডিবির বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তবে এসব কেন্দ্র পুরোনো হয়ে পড়ায় নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে।
চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ‘আমাদের গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১১০০০ মেগাওয়াট। আমরা ৬০০০ থেকে ৬৫০০ মেগাওয়াট গ্যাস দিয়ে উৎপাদন করছি।’ এসব কেন্দ্রে উৎপাদন কম হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জ্বালানি সংকটকে দায়ী করেন।
১০০ মেগাওয়াটের একটি কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক অন্তত ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সেই হিসেবে নির্মাণাধীন ৩০৬১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক অন্তত ৬১২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। পৃথকভাবে দেখলে সামিটের জন্য ১১৬ মিলিয়ন ঘনফুট, ইউনিক পাওয়ারের জন্য ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট, রিলায়েন্সের জন্য ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট, এনডব্লিউপিজিসিএলের জন্য ১৬০ মিলিয়ন ঘনফুট, আরপিসিএলের জন্য ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রয়োজন। আরপিসিএলের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ডুয়েল ফুয়েলভিত্তিক। গ্যাসের পাশাপাশি ডিজেল দিয়েও চালানো যাবে। তবে ১ ইউনিট ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ টাকার বেশি খরচ হয়। এ কারণে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে।
এখন সব মিলিয়ে দেশীয় উৎস থেকে দৈনিক ২১০০ থেকে ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া এলএনজি থেকে আসে আরও ৬৫০ থেকে ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অর্থাৎ দৈনিক যে ২৭০০ থেকে ২৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশই আমদানি করা। দেশে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। যেগুলো দিয়ে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল সক্ষমতার শতভাগ এলএনজি সরবরাহ করতে পারে না।
দেশের টার্মিনাল দুটি যে পরিমাণ এলএনজি সরবরাহ করে তা যথেষ্ট। এগুলো থেকে গ্যাস সরবরাহ আর বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার দেশের খনিগুলো থেকেও প্রতিদিন এত বিপুল গ্যাসের জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া খনিগুলোর উৎপাদনক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে কমছে। ফলে নিকট ভবিষ্যতে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া কঠিন। দেশে এখন গ্যাসের চাহিদা রয়েছে ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ সাংবাদিকদের জানান, তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদানের আগেই তাদের এলাকার সব কেন্দ্রের সঙ্গেই গ্যাস সরবরাহ চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী তারা গ্যাস দিতে বাধ্য। তিনি বলেন, কিন্তু গ্যাস সরবরাহ যে দেব তেমন গ্যাস তো নেই। তিনি বলেন, এসব কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ দিতে হলে নতুন একটি পাইপলাইন নির্মাণ করতে হবে।
কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে সরকার ও পিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি রয়েছে। আবার কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ করার জন্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানি চুক্তিও করেছে। তাই গ্যাস থাক বা না থাক, তাদের এখন বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু (সিওডি) করার জন্য গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। মেঘনা ঘাটের কেন্দ্রগুলো যদি ধারাবাহিকভাবে অর্থাৎ একটির পর আরেকটি গ্যাস সরবরাহ নিয়ে সিওডি করে ফেলে, তখন ওই কেন্দ্র চালানো হোক বা না হোক তাদের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, পাওয়ার পার্চেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (পিপিএ) অনুযায়ী এসব কেন্দ্রের একবার সিওডি হলে তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ নেয়া হোক আর না হোক তাদের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। তিনি বলেন, এসব কেন্দ্রকে কাজ দেওয়ার সময়ই বোঝা উচিত ছিল গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে কি না। কিন্তু কেন্দ্রগুলো অনুমোদনের সময় প্রভাব বিস্তার করে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে গ্যাস সরবরাহের সম্মতিপত্রও নিয়েছে।
এদিকে ভারতের এইচ এনার্জির কাছ থেকে এলএনজি সরবরাহ পাওয়া যাবে, এটি নিশ্চিত হওয়ার পর পিডিবি থেকে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি এনডব্লিউপিজিসিএল-কে বলা হয় যশোরে একটি ৮০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রটির জন্য খুলনায় জমি পায় এনডব্লিউপিজিসিএল। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের মধ্যে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এটির নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। কেন্দ্রটি নির্মাণের শুরুতেই ভারতের উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে এইচ এনার্জি। ফলে এইচ এনার্জি আর এলএনজি সরবরাহ করতে পারেনি।
এমন অবস্থায় কেন্দ্রটিতে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে পায়রায় একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তাব পাঠায় এনডব্লিউপিজিসিএল। এ জন্য তারা ঢাকা থেকে পায়রা পর্যন্ত পাইপলাইনের রুট সার্ভে করা ছাড়াও সম্ভাব্যতা জরিপের কাজ করে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে পেট্রোবাংলাকে দিয়ে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু পেট্রোবাংলা এখনও এক্ষেত্রে কোনো বাস্তব অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক রহমত উল্লাহ গনমাধ্যমকে বলেন , ‘বসে বসে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট নেয়া একটা ভালো ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এসব কেন্দ্র উৎপাদনে থাকুক বা না থাকুক, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ঠিকই দিয়ে যেতে হবে। একবার এ ধরনের কেন্দ্র উৎপাদনে এলে শর্ত অনুযায়ী সেটিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।