একথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলার অবকাশ নেই যে, বিগত ‘দেড় দশক’ নয় বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার শুরু আশির দশক থেকে। সুদূর অতীতের ‘ডিকেডস অব রিফর্মস’-এর আদলে বাংলাদেশে কারো কারো অবৈধতার বদনাম মোছা কিংবা বেশি সময় ধরে গদিনসীন থাকার উপায় হিসেবে বিদেশী সাহায্য দেয়া-নেয়ার নাম করে বিদেশী সাহায্যদাতাদের প্রধান দেশ বা সংস্থাসমূহ থেকে আম ও ছালা দুই-ই জুটবে। পরের টাকায় রাস্তা তৈরি হবে, সেতু নির্মিত হবে। এসব অবকাঠামো তৈরিতে কৃষিজমি ব্যবহৃত হলো, খাল বিল ভরাট হলো। প্রচুর রাস্তা তৈরি হলো। রাস্তা তৈরি করা মানে হচ্ছে নদীর পানিপ্রবাহ, খালবিলের পানিপ্রবাহ এগুলো সব বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। এর ফলে দেখা গেল নদীগুলো আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে যাচ্ছে এবং নদীগুলো সংস্কার হচ্ছে না। ফলে হঠাৎ বৃষ্টি এসে বন্যা হচ্ছে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জলবায়ুর তারতম্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে বেশি বেশি সড়ক বানানোয়। সবাই ওই সড়কের দিকে ধাবিত হলো- মানুষ আর নৌপথে চলাচল করতে চায় না। ফলে নদীর প্রতি আগ্রহ, আকর্ষণ ও নাব্যতা রক্ষার দায়িত্বে গাফিলতি চলে এলো। সড়কপথ তৈরিতে বিদেশীরা যে সাহায্য দিয়েছিল, তারা চেয়েছিল যে এমন একটা সড়ক প্রধান দেশ হোক যেখানে প্রচুর গাড়ি ব্যবহার হবে। গাড়ির রফতানিকারক ডোনাররা চান; মানুষ গাড়ি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকবে, কিন্তু গাড়িতে চড়ার অর্থনীতিতে তার যে নিজস্ব শক্তি সেটি অর্জনে মন মাথা ঘুরে গেল। মানে প্রচুর রাস্তা তৈরি হলো এবং কৃষিজমি নষ্ট হলো। নদী, খালবিলের পানিপ্রবাহ নষ্ট হলো। গ্রামের মানুষ খুব সহজে শহরে আসার দিকে ধাবিত হলো। কারণ, যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হয়েছে এবং গ্রামের উন্নতির দিকে মন দেয়ার দরকার নেই। কর্মকর্তাদের পরিবার মহানগরে থাকে, মফস্বলের শহরে তাদের ছেলেমেয়েরা পড়ে না, চিকিৎসা নেয় না। গ্রামের সবজি, ফলমূল, পুষ্টিকর খাবার, মাছ গোশত সহজে দ্রুত শহরে যাওয়ার পথ তৈরি হলো। পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়নে যে বিভ্রাট ভর করল নীতি নির্ধারকের মাথায়; তা নদীমাতৃক ও কৃষিনির্ভর দেশে নদীর প্রতি খেয়াল রাখার ঔচিত্যবোধ উবে গেল। নদীমাতৃক যাতায়াত, যোগাযোগ ব্যবস্থায় শান্ত সুনিবিড়ে স্বাস্থ্যসম্মত সবকিছু করা সম্ভব ছিল। এখন সড়কে দামি জ্বালানি ব্যয় হয় এবং অহরহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বাড়ে বেশুমার। বিদেশী গাড়ির একচেটিয়া ব্যবসায়ী যখন নিষ্ফল উপদেশ বিলান ‘একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না’ তখন নদীর কান্না কি কেউ শুনতে পায়? শত শত সেতু যখন উদ্বোধন হয় তখন ছোটবড় সব নদীর কপাল পুড়ে, নদী শুকিয়ে যায়। নাব্যতা হারায়। নদীগুলোর ন্যব্যতা রাখতে সেতু না বানিয়ে আধুনিক ও অধিক সংখ্যায় ফেরি দিলে পরিবেশ বাঁচে, জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হয়। শহরের ঝিল, খাল-পুকুর ভরাট না করে সেগুলোর নাব্যতা বাড়ালে পর্যটন বিনোদন এবং অগ্নিনির্বাপণে পানি মিলে। পরিকল্পনা প্রণয়নকারী নীতিনির্ধারকরা হিসেব কষে দেখতে পারেন, সড়ক-সেতুপথের চাইতে নদীপথ ব্যবহারের ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন অবশ্যই বেশি।
বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক ফাঁপরে পড়ে যায় আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার পানি উজানে সরানোর মতলবে ফারাক্কায় আটকানো পানির হিস্যা চাওয়া-পাওয়ার বেলায়। বিশ্বব্যাংকের লোন নিয়ে ভারত যে ফারাক্কা বাঁধ বেঁধেছিল, সেই ফারাক্কা বাঁধ কিন্তু পাকিস্তান আমলে কার্যকর করতে পারেনি। কারণ কৌশলগতভাবে পাকিস্তান সিন্ধু নদীতে বাঁধ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করবে একথা বলাতে এর ভেতর দিয়ে পাকিস্তান কিন্তু ভারতের গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ দেয়ার ব্যাপারটি আটকে রেখেছিল। এটি কিন্তু এরকম ছিল না যে, ভারত ফারাক্কায় পানি আটকে দিলে বেচারা পূর্ব পাকিস্তান শুকিয়ে যাবে। কষ্ট হবে এ কথা ভাবার চেয়ে পাকিস্তান ভেবেছিল ভারতকে যেভাবে হোক একটু আটকালে দেশটির উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ভারতের সাথে পাকিস্তানের নেগোশিয়েট করতে সুবিধা হবে। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পর গঙ্গার পানি বণ্টন প্রশ্নে বাংলাদেশ সঙ্গতকারণে নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়। ১৯৭২ সালে ‘এক সপ্তাহের জন্য ভারত পরীক্ষামূলক ফারাক্কা বাঁধ চালু করলেও’ সে চালু আর বন্ধ হয়নি, পানি ভাগাভাগির কূলকিনারা হয়নি। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী ফারাক্কা অভিমুখী লংমার্চ করেন। এটি ছিল বাংলাদেশ থেকে প্রথম এবং শেষ রাজনৈতিক প্রতিবাদ।
ভারতের ফারাক্কায় এবং তিস্তা নদীর পানি উজানে আটকানোর ফলে ভাটিতে নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ মরুভূমির মতো পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার উজানে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের প্রমত্তা পদ্মায় শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নাব্যতা হারিয়ে যায়, যাতায়াত যোগাযোগ ব্যবস্থা বিনষ্ট হয় এবং এমনকি পদ্মা ও তিস্তার শাখা নদীগুলো (যা বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৬৫ শতাংশ অঞ্চলের অববাহিকা) পানিশূন্য হয়ে ভরাট হয়ে বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক পানিপ্রবাহে এতদঞ্চলের জীববৈচিত্রে হুমকি ও অমানবিক বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। জিকে ও তিস্তা ইরিগেশন প্রজেক্টের আওতায় পানি ব্যবস্থাপনার যে ব্যবস্থা ছিল তাও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পের কথা মাঝে মধ্যে শোনা যায়। কিন্তু এগুলো আসলে কার্যকর করা যায় না। ফলে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি ক্রমশ দেউলিয়া হতে চলেছে। মধুমতি বা অন্যান্য নদীর মিষ্টি পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের লোনা পানি আরো উপরে এসে পুরো সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে। ভারতের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমতি না মিললেও বাংলাদেশের সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালুতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনার মতো অদূরদর্শিতার পরিচয় ফুটে উঠছে।
সুন্দরবন কিন্তু অনেক ছোট হয়ে গেছে। সুন্দরবনের ওপর একটি বই আমি সম্পাদনা করেছি। সেখানে দেখেছি, এক-তৃতীয়াংশ ভারতের ভাগে পড়া সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বরং বেড়েছে আর বাংলাদেশের ভাগে যে দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে; সেখানে গত কয়েক দশকে বাঘের সংখ্যা কমে গেছে। ফারাক্কার প্রভাবে প্রাকৃতিক রক্ষা ঢাল সুন্দরবনের বিপর্যয়, পশ্চিম বঙ্গের নৌপথ ও বন্দর বিনষ্ট এমনকি আসাম ও বিহারে অকাল ও অস্বাভাবিক বন্যার কারণ সৃষ্টি হয়েছে। ফারাক্কা যখন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারক ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখা দেয়, তখন ১৯৯৬ সালে আন্তর্জাতিক নদীর গঙ্গার পানি বণ্টনের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ ও নেগোশিয়েশনের সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যায়। তিস্তা চুক্তি ঝুলে থাকায় শুষ্ক মৌসুমে হিসাবের পানিও মেলে না। আর ভরা বর্ষায় অস্বাভাবিক পানি প্রবাহে ভেসে যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দ্বারা বাংলাদেশের পুরো পরিবেশ পরিস্থিতিতে গঙ্গা-তিস্তার খারাপ প্রভাব নিয়ে প্রতিবাদ স্থিমিত হলেও এখন খোদ ভারতের আসাম, বিহার এবং অন্যান্য রাজ্য ও অঞ্চল থেকেও ফারাক্কা ভেঙে দেয়ার দাবি উঠেছে। কারণ, ফারাক্কার ওখানে পলি জমে। এ প্রসঙ্গে যেটা বলার চেষ্টা যে দূরদর্শী পরিকল্পনার অবর্তমানে প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের তরফে কূটনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক সমস্যার প্রতি করণীয় ভূমিকা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সুষ্ঠু ও দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে। এসব কারণে প্রকৃতির সাথে মিল রেখে যদি বাংলাদেশ পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা না নিতে পারে বা বিলম্ব করে তার খেশারত দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে না হলেও কিংবা এখন এটা স্বাভাবিক মনে হবে যে যেহেতু সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি কোথাও যাওয়ার অবকাঠামো গড়ে উঠছে, আপাতত সবকিছু ঠিক মনে হচ্ছে; কিন্তু আখেরে বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্বয়ম্ভরতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও তার কার্যকারিতা হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় এই যে- বহু সেতু বানানো হচ্ছে, সেতু কোথায় বানানো হয়? নদীর ওপর। নদীর ওপর সেতু বানানো হয়, কিভাবে বানানো হয়, যেভাবে হোক দেখা যাচ্ছে যে ওখানে নদীর পানির প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এই যে ছোট-বড় নদী এসবের পানি প্রবাহের পথ কিন্তু থেমে যাচ্ছে। এবং সেতুর ওপর দিয়ে সহজে পার হওয়ার জন্য মানুষ কিন্তু নিচের নদী বা খালটার প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। অমনোযোগী হয়ে যাওয়াতে সেগুলো আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি এখানে এরকম হতো, সেতু না থেকে যদি পর্যাপ্ত ফেরি থাকত, দ্রুত ও নির্বিঘ্নে পারপারের ব্যবস্থা থাকত তাহলে কিভাবে নৌপথ নাব্য থাকতে পারে, সেভাবে নদীর ওপর নজর বাড়ত। কিন্তু সেতু বানানোতে একদিকে যেমন পানিপ্রবাহে প্রভাব পড়ছে, আরেকদিকে খাল-বিল, মৎস্যের আধার, সেচের আধার এসব কিছুর প্রতি রাষ্ট্রের মনোযোগ কমে যাচ্ছে।
আমরা প্রচুর সেতু বানাচ্ছি, এসব সেতু বানাতে বিদেশীরা টাকা দিচ্ছে যাতে তাড়াতাড়ি সেতু হয়, সেই টাকা বেহাত হয়ে পাচার হয়ে বিদেশে যাচ্ছে, আগে চট্টগ্রামে যেতে মেঘনা গোমতিতে দুটো ফেরি ছিল, জাপানিরা রীতিমতো অনুদানের টাকায় মেঘনা গোমতি সেতু বানিয়ে দিলো। খ্বু ভালো কথা; কুমিল্লা-চট্টগ্রাম যাতায়াতে সুবিধা বাড়ল। কিন্তু সেতু বানানোর পর পরিবেশবান্ধব নৌপথ নদী ও রেল যোগাযোগের প্রতি অমনোযোগিতা বেড়ে গেল। মেঘনার উজানে সুরমা, কুশিয়ারা নাব্যতা হারিয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে সিলেটে গতবার যে বড় বন্যা হয়েছিল, এগুলো হতে থাকবে এবং আরো সমস্যা হবে।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক