প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারা দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের ১৯শে জুন পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজার ২৩১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ৩৬ জন। আর এ মাসের ১৯ দিনেই মারা যান ২৩ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩ হাজার ২০৯ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুনে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যু অনেক বেড়ে গেছে।
এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে জুলাই থেকে পরবর্তী তিন মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) ডেন-২ এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২ এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩ এ।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এই তথ্য জানিয়েছে।
কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বলেন, মাঠ পর্যায়ে আমরা কাজ করছি। আমরা এডিস মশার ঘনত্ব ও ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা যা দেখছি তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পরিস্থিতি আসলে ভালো নয়। যদি আমরা এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
জুলাই মাসে এটি আরও বাড়ার আশঙ্কা করছি। বিশেষ করে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাস আমাদের জন্য খুব ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হচ্ছে। আমরা এডিস মশার ঘনত্ব বেশি পাচ্ছি বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায়। এই সময়ে ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কবিরুল বাশার বলেন, গত বছরের একটা প্রভাব এখানে আছে।
প্রকৃতিতে গত বছরের ডেঙ্গু রোগী যেহেতু ছিল সে জন্যও এটা বেড়ে গেছে হঠাৎ। এ ছাড়া পানি জমার কিছু উৎস সারা বছরই থাকায় এডিস মশা সারা বছরই আমরা পাচ্ছিলাম। আবার এখন বৃষ্টি শুরু হওয়ায় পানি জমার স্থান আরও বেড়েছে। অধ্যাপক কবিরুল বাশার বর্তমান পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য হটস্পট ম্যানেজমেন্টের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে সেই ঠিকানা ধরে সেখানে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। সেখানকার মানুষজনকে সচেতন করতে হবে এবং নিজেদের বাড়ির আঙ্গিনা ও অন্যান্য জায়গা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, যেন এডিস মশার প্রজনন না হতে পারে।
চলতি বছরের ডেঙ্গুর সামগ্রিক চিত্র: দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। ডেঙ্গু মৌসুম আসার আগেই এবছরে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩২৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫৮ জনে। একদিনে আরও দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। জুনে মাসে ২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৬ জনে।
গতকাল সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৩২৩ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ২৬০ জন এবং ঢাকার বাইরে ৬৩ জন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, নতুন ৩২৩ জনসহ বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৫৮ জনে। ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯১৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৪৪ জন।
চলতি বছরের এ পর্যন্ত ৫ হাজার ২৩১ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ৪ হাজার ৩৭ জন। অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৩ হাজার ২০৯ জন এবং মারা গেছেন ২৩ জন।
এ বছর ডেঙ্গুর ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) ডেন-২ এ বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। সীমিতসংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ রোগী ডেঙ্গুর ধরন ডেন-২ এ আক্রান্ত হয়েছেন। বাকি ৩৮ শতাংশ আক্রান্ত হয়েছেন অন্য ধরন ডেন-৩ এ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ডেঙ্গুর ধরন সম্পর্কে এই তথ্য জানিয়েছে।
রোগতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন: ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ এবং ডেন-৪। ডেঙ্গুর একটি ধরনে আক্রান্ত হলে সেই নির্দিষ্ট ধরনের প্রতিরোধক্ষমতা শরীরে গড়ে ওঠে, পরবর্তী সময়ে সেই ধরনটিতে মানুষ আর আক্রান্ত হয় না। তবে অন্য ধরনে মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। এভাবে মোট চারবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও জটিলতা দুটিই বাড়ে। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন গণমাধ্যমকে বলেন, আইইডিসিআর ঢাকার একাধিক হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীর নমুনা সংগ্রহ করেছে। গত সপ্তাহে এসব নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৬২ শতাংশ নমুনায় ডেন-২ শনাক্ত হয়েছে। আর ৩৮ শতাংশ নমুনায় ডেন-৩ শনাক্ত হয়েছে। তাহমিনা বলেন, ২০২২ সালে নমুনা বিশ্লেষণে প্রাধান্য ছিল ডেন-৩-এর। ৯০ শতাংশ রোগী আক্রান্ত হয়েছিল ডেন-৩-এ। বাকি প্রায় ১০ শতাংশ ছিল ডেন-৪।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, এবার যদি ডেন-২ এর পরিমাণ বেশি থাকে এবং মানুষ যদি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হন, তাহলে রোগের জটিলতা বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে। গত সপ্তাহে সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেছিলেন, হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে ডেঙ্গুর ‘শক সিনড্রোম’ বেশি দেখা যাচ্ছে। শক সিনড্রোমের অর্থ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর রক্তের অণুচক্রিকা দ্রুত কমে যায়। রোগীর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়ে, রোগী অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যায়।