জাতীয় নির্বাচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার বছর এলেই বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার বেড়ে যায়। এ সময়ে ক্ষমতা পরিবর্তনের শঙ্কায় কিছু রাজনীতিবিদ, আমলা ও ব্যবসায়ী বিভিন্ন দেশে অর্থ নিয়ে যান।
গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে এ তথ্য মিলেছে। সংস্থাগুলোর রিপোর্ট অনুসারে আগের বছরের তুলনায় ২০১৮, ২০১৪ এবং ২০০৭ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়েছে। আলোচ্য বছরগুলো বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচিত ছিল।
সুইজারল্যান্ডে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা সুইস ব্যাংক প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন হয়েছে, ওই বছর টাকা পাচার বেড়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম অস্থির বছর ছিল ২০০৭ সাল। বছরটিকে ওয়ান-ইলেভেন হিসাবে ধরা হয়। ওই বছর টাকা পাচার বেড়েছে। ২০০৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ১২ কোটি ৪০ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ১১৮ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় তা ১ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০০৭ সালে তা বেড়ে দ্বিগুণ ২৪ কোটি ৩০ লাখে উন্নীত হয়।
এছাড়াও ২০১৪ সালে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগের বছর ২০১৩ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৩৭ কোটি ১৮ লাখ ফ্র্যাংক। কিন্তু ২০১৪ সালে অর্থাৎ নির্বাচনি বছরে তা বেড়ে ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্র্যাংকে উন্নীত হয়। ২০১৮ সালে এগারোতম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর ২০১৭ সালে বাংলাদেশিদের আমানত ছিল ৪৮ কোটি ১৩ লাখ ফ্যাংক। কিন্তু ২০১৮ সালে তা বেড়ে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্যাংকে উন্নীত হয়। সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত ৮৭ কোটি ২১ লাখ সুইস ফ্র্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ১০ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কয়েক বছর পর্যন্ত অর্থ পাচার বাড়ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। তিনি বলেন টাকা পাচারের অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যতম। সাধারণত রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির হলে টাকা পাচার হয়ে থাকে। এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। কিন্তু অনিশ্চয়তা আছে।
যে কোনো সময় অস্থির হতে পারে এই আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে বিনিয়োগ না হলেও টাকা পাচার বাড়ে। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের সিংহভাগই সুনির্দিষ্ট ১০ দেশে যায়। এক্ষেত্রে কর সুবিধা পাওয়া যায় এবং আইনের শাসন আছে, অপরাধীরা সে সব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে-সংযুক্ত আবর আমিরাত, সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। পাচারকারীদের অধিকাংশই প্রভাবশালী।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ৫ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এরমধ্যে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার পর পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নেবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের বড় রোড দুবাই। বিভিন্ন ব্যক্তি বড় অঙ্কের ঘুস লেনদেন করলে সেটি বাংলাদেশে নয়, দুবাইতে বসে ডলারে পরিশোধ করতে হয়। পরে তা বিভিন্ন দেশে চলে যায়। এরপর আসে সিঙ্গাপুরের নাম।
আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য আসছে। এগুলো হলো-জিএফআই, সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে) প্রকাশিত পানামা, প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপার্স, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সেদেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশ কিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে।
তবে পাচার হওয়া কিছু টাকা সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) আকারে ফেরত আসছে বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পাচার ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে এই টাকা আর দেশে ফেরত আসবে না। চলতি বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে এই অর্থ ফেরত আনার সুযোগও দিয়েছে সরকার। তবে কর দিয়ে অর্থ আনার ক্ষেত্রে সাড়া মেলেনি।
এদিকে হুন্ডি সন্দেহে ১০ হাজার ২২৩ জন সুবিধাভোগীর হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব হিসাবে অর্থের অঙ্ক ৩ কোটি ৫১ লাখ ২৯ হাজার ২৩৫ টাকা। এর মধ্যে বৈধপথে অর্থ পাঠাতে উদ্বুদ্ধ করে আবার ৪ হাজারের বেশি হিসাব সচল করা হয়।
জানা গেছে, বিদেশে শ্রমিক যাওয়া বাড়লেও হুন্ডির প্রবণতা বৃদ্ধির ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স আসছে না। অন্যতম কারণ অর্থ পাচারকারীরা হুন্ডিকে ব্যবহার করে বিদেশেই টাকা রেখে দিচ্ছে। দেশে ওই প্রবাসীদের পরিবারকে বাংলাদেশি মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করছে। যা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এদিকে শেয়ারবাজারে জালিয়াতির মাধ্যমে ৪ মিউচুয়াল ফান্ড থেকে ২৩৫ কোটি ১২ লাখ টাকা সরিয়ে নিয়েছে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি ইউনিভার্সাল ফাইন্যান্সিয়াল সলিউশন (ইউএফএস)। এরমধ্যে ইউএফএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ হামজা আলমগীরের নেতৃত্বে ১৭০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরাসরি আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই টাকা নিয়ে ১৩ অক্টোবর তিনি দুবাই পালিয়েছেন। এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিএসইসি আদালতে মামলা করেছে। এছাড়াও বহুল আলোচিত পিকে হালদারের পাচার অর্থের উল্লেখযোগ্য অংশ রয়েছে দুবাইতে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ৯১ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে অর্থ পাচারে শতাধিক বাংলাদেশির নাম উঠে এসেছে। এরমধ্যে রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ীদের নেতাদের নাম রয়েছে।
জানা গেছে, বৈধ পথে রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে কয়েক বছর ধরেই আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। এখন কেউ ১০০ টাকা রেমিট্যান্স পাঠালে তা দেশে যিনি গ্রহণ করেন, তিনি পান ১০২ টাকা ৫০ পয়সা। এই সুযোগ অর্থ পাচারকারীরা নিচ্ছে বলে অনেকের সন্দেহ।
এদিকে পাচারকৃত অর্থ রেমিট্যান্স আকারে দেশে আসছে বলে সন্দেহ করছে সিপিডি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২১ লাখ ব্যক্তি দেশের বাইরে গেছেন। এরমধ্যে ১১ লাখের বেশি সৌদি আরবে। কিন্তু সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কমছে।
বিপরীতে বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে এ বিষয়ে খুব ভালোভাবে অনুসন্ধান হওয়া দরকার। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। এ যাবৎকাল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স বেশি এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বেশি আসছে আমেরিকা থেকে। তিনি বলেন, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৩ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২ দশমিক ৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা চলতি বছরের জুলাই-এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। ফাহমিদা খাতুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে যারা যায় তাদের বেশিরভাগই বৈধ চাকরি (হোয়াইট কালার জব) করেন। অনেক শিক্ষার্থীও সে দেশে আছেন। তারা তো আর টাকা পাঠাতে পারেন না। তাহলে বিপুল এ রেমিট্যান্স আসছে কোথা থেকে। তারমতে, যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হওয়া অর্থ রেমিট্যান্স আকারে আসছে।