গত ১০ জুন শনিবার দীর্ঘ ১০ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে মিটিং করার পারমিশন দিয়েছিল। সেই পারমিশন নিয়ে একটি চিহ্নিত মহল এবং তাদের পন্থী মিডিয়াগুলোতে কি হুলুস্থূল। ১০ বছর পর জামায়াতে ইসলামীকে মিটিং করার পারমিশন দেয়ার পেছনে কি কারণ রয়েছে? কেউ কেউ তো তাদের কল্পনার ফানুস এতদূর উড়িয়েছেন যে তারা এই পারমিশনের মধ্যে আঁতাতের গন্ধও পেয়েছেন। যারা এই ধরনের কল্পনার ফানুস উড়াচ্ছেন তারা অধিকাংশই আওয়ামী ঘরানার লোক। এরা আবার গণতন্ত্রের বুলি যখন তখন কপচান। যারা গণতন্ত্রের ললিত বাণী অষ্ট প্রহর উচ্চারণ করেন তাদের তো বরং এই প্রশ্ন করা উচিত ছিল যে এক দিন নয়, দুই দিন নয়, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জামায়াতকে জনসভা করার অনুমতি দেয়া হয়নি কেন? আজও এদেশে একটি শাসনতন্ত্র আছে। আওয়ামী সরকার তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের কথা উঠলে যখন তখন শাসনতন্ত্রের দোহাই দেয়। ঐ শাসনতন্ত্রে স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে যে জনগণের সভা সমাবেশ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। একথা কেউ বলেননি যে ১০ বছর পর পারমিশন দেয়া হলো, তাও আবার উন্মুক্ত স্থানে নয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের চার দেয়ালের ঘেরা টোপের মধ্যে সভা করার অনুমতি দেওয়া হলো। কিন্তু দেখা গেল জনতার ঢল। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের চার দেয়াল কানায় কানায় পূর্ণ। জনতার ঢেউ উপচে পড়ে হলের বাইরে খোলা যায়গায়। সেখানেও স্থান সংকুলান হয় না। তখন জনতা রাস্তায় আসে এবং সেখান থেকে মৎস ভবন পর্যন্ত মানুষের সয়লাব হয়ে যায়। এই পর্যায়ে পুলিশ ব্যারিকেড দেয় যাতে করে জনসাধারণ রাস্তায় আর বেশি দূর যেতে না পারে।
জামায়াতকে সভা করার অনুমতি কেন দেয়া হলো সে ব্যাপারে প্রশ্ন করলে একেক মন্ত্রী একেক রকম জবাব দেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালত জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করে ততক্ষণ পর্যন্ত জামায়াত দোষী নয়। তবে তিনি সাথে এটাও যোগ করেন যে জামায়াতের নেতাদের মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলার শুনানিতে যে সমস্ত পয়েন্ট উঠে এসেছে সেসব পয়েন্টের যুক্তিতেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। তবে আনিসুল হক একজন আইনজ্ঞ। তিনি জানেন যে সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদও নাই যেখানে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। সেজন্য তিনি বলেন যে আইন সংশোধন করা হচ্ছে।
শীঘ্রই সংশোধনের ঐ খসড়া মন্ত্রিসভায় পেশ করা হবে। মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলে জাতীয় সংসদে সেটি পেশ করা হবে। জাতীয় সংসদ ঐ সংশোধনী পাশ করলে সেটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হবে। অতঃপর ঐ সংবিধানের অধীনে জামায়াতের বিচার করা হবে।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন যে জামায়াতকে সভা করার অনুমতি দেয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণটি কি সেটি তিনি অবশ্য উল্লেখ করেননি।
তো যতক্ষণ যথাযোগ্য আইনের অধীনে যথাযথ এবং ন্যায্য বিচার করে যতক্ষণ না জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জামায়াতকে সাংবিধানিক অধিকার বলে কোনো রকম সভা সমাবেশ বা মিছিল করা থেকে বিরত রাখা যাবে না। এই ১০ বছর ধরে যা কিছুই করা হলো সেটি ¯্রফে গায়ের জোরে। সরকারের হাতে পুলিশ আছে, র্যাব আছে, বিজিবি আছে। আর আছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লাঠিয়াল বাহিনী। এদের জোরে জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ১০ বছর ধরে বের হতে দেওয়া হয়নি। শুধুই কি সভা সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি? এমনকি মসজিদে নামাজ পড়তে গেছেন জামায়াতের নেতাকর্মী। সেখান থেকে কয়েকজনকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সেই ছক বাধা অভিযোগ। ওরা নাকি নাশকতা করার ষড়যন্ত্র করছিল। শুধুমাত্র পুরুষ নয়, জামায়াতের মহিলা সমর্থক কর্মীরাও কোরআন মাজিদের তাফসির বা এই ধরনের একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। সেখান থেকেও এইসব ভদ্র ও পর্দানশীল নারীদেরকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে তারা নাকি নাশকতা করার ষড়যন্ত্র করছিলেন।
সরকার তথা পুলিশের হাতে রয়েছে আরেকটি রেডিমেড অভিযোগ। যখনই কোনো জামায়াতের পুরুষ বা মহিলা সমর্থককে আটক করা হয় তখন বলা হয় যে তাদের কাছে নাকি জিহাদী বই পাওয়া গেছে। জিহাদী বই কি? দেখা যায় যে সেগুলো ইসলামী অর্থনীতি, অথবা ইসলামে নারীর অধিকার প্রভৃতি। এক কথায় ইসলাম সম্পর্কে বই। এখন ইসলাম সম্পর্কিত বইগুলোও আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের পুলিশ বাহিনীর কাছে জিহাদী বই হয়ে যায়। এ পর্যন্ত যত হাজার জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের একজনের বিরুদ্ধেও নাশকতার ষড়যন্ত্রের কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। অভিযোগ প্রমাণ তো দূরের কথা, কোনো অভিযোগই উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
॥দুই॥
জামায়াত ও শিবিরের বিরুদ্ধে এসব মনগড়া অভিযোগ উত্থাপনের আসল মতলব কি? যারা এর মধ্যে সরকারের সাথে জামায়াতের আঁতাতের গন্ধ আবিষ্কার করছেন তাদেরই বা মতলব কি? এসব আজগুবি অভিযোগ ও প্রোপাগান্ডা করে কোনো লাভ হয়নি। বরং ডেইলি স্টারের রিপোর্ট মোতাবেক এই সময় সব দিক দিয়ে জামায়াতের শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে কমপক্ষে অন্তত তিন গুন। এটি আমাদের কথা নয়, বরং এটি ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠার রিপোর্ট। এই রিপোর্ট সম্পর্কে একটু পরে আমি কথা বলবো। তার আগে আসুন, জানা যাক, এই বানোয়াট আঁতাতের কাহিনী ফাঁদা হচ্ছে কেন?
এই কাহিনী ফাঁদার পেছনে মতলব অতি পরিষ্কার। সেটি হলো, ক্ষমতায় যাওয়ার যোগ বিয়োগ। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে ভোটের রাজনীতির গণিত বা অংক। এ কথা এখন রাজনীতি সচেতন মানুষ বিলক্ষণ বুঝে গেছেন যে যদি বাংলাদেশে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শক্তি এক জোট হয় এবং এক জোট হয়ে থাকে তাহলে জিন্দেগীতেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। সেজন্য শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ নয়, তাদের মেন্টর ভারতেরও কৌশল হলো কোনো অবস্থাতেই যেন বিএনপি, জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলামী শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন এবং ইলেকশন করতে না পারে।
১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াত তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। আন্দোলন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করার মধ্যে অন্যায় কিছু হয়তো ছিল না। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক আদায় করার পর ১৯৯৬ সালে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন পায়। কিন্তু তারপরেও তারা সরকার গঠন করার মতো একক মেজরিটি অর্জন করতে পারেনি। লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই যে ঐ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি। তারপরেও আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। তখন ইত্তেফাকের মালিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং জাসদের আ স ম আব্দুর রবকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ ন্যূনতম মেজরিটি অর্জন করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সেদিন যদি জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শক্তি এক থাকতে পারতো তাহলে হয়তো বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতির ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো।
॥তিন॥
এই ভুলটি আর জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী শক্তিরা ২০০১ সালের নির্বাচনে করেনি। ঐ নির্বাচন তারা একসাথে করেছিল। ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা আগের নির্বাচনের ১৪৬টি থেকে এক লাফে নেমে ৭০ এ এসেছিল। পেছনের যে ইতিহাস আমি এখানে টানলাম তার একটি কারণ রয়েছে। আর ৬ থেকে ৭ মাস পর দেশের ইলেকশন। বিএনপি এবং জামায়াত বলেছে যে তারা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া ইলেকশনে যাবে না এবং সেই ইলেকশন হতেও দেবে না। আর আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তাদের অধীনেই এবং তাদের জাতীয় সংসদ বহাল রেখেই ইলেকশন করা। এই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ করেছে শাসনতন্ত্রে পঞ্চদশ সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত করে। ২০২৩ সালের রাজনৈতিক অবস্থা এবং পরিবেশ ২০১৪ এবং ২০১৮ সাল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। বিগত ৫/৬ মাস ধরে বিএনপি, জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ প্রভৃতি দল এবং জোটের সভা এবং মিছিলে যে অভূতপূর্ব জনসমাবেশ হয় সেটি এক কথায় অকল্পনীয়। বিরোধী দলের নেতাদের ধারণারও বেশি জনসমাগম হয়েছে। পরিষ্কার হয়ে গেছে যে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ ২০টি আসনও পাবে কিনা সন্দেহ। এখন তাদের এই আসন্ন ভরাডুবি এড়াতে গেলে সেই পুরাতন মহাজনি পন্থা অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শিবিরের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও আওয়ামী লীগ সরকারের বিপক্ষে। মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা পশ্চিমা শিবিরের দাবি হলো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সুরক্ষা। তাদের দাবি হলো ইলেকশনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। কিন্তু এগুলি করা হলে ইলেকশনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে।
তাই এই সরকার এবার চীনা শিবিরে ভিড়েছে। চীনের কাছে গণতন্ত্রের কোনো বালাই নাই। রাশিয়াতেও তাই। তাদের অনুসারী উত্তর কোরিয়াতেও গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের নাম গন্ধও নাই। চীনের আরেক বশংবদ মিয়ানমারে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরা হয়েছে। চীন তাই বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন চায়। এখানে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের স্বার্থের মিল হয়েছে।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী শক্তি যদি ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে কোনো বিদেশী মদদের প্রয়োজন হবে না। অন্তত ৯০ শতাংশ ভোট স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শিবিরের বাক্সে পড়বে। এই সত্যটি ভারত এবং আওয়ামী লীগ বুঝেছে। তাই তারা ছলে বলে কৌশলে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী শিবিরের মধ্যে ভাঙন ধরাবার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে লেগেছে।
শেষ করার আগে ডেইলি স্টারের ঐ রিপোর্ট প্রসঙ্গ। বলা হয়েছে যে ২০০৮ সালে জামায়াতের রুকনের সংখ্যা ছিল ২৩ হাজার ৮৬৩। এখন ঐ সংখ্যা হলো ৭৩ হাজার ৪৬। ২০০৮ সালে জামায়াতের সক্রিয় কর্মীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ২১ হাজার। এখন তার সংখ্যা হলো ৬ লক্ষ ৩৯ হাজার। পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রের একটি তথ্যে নাকি এসব পরিসংখ্যান দেয়া হয়েছে। ডেইলি স্টার দাবি করেছে যে পুলিশের ঐ গোয়েন্দা রিপোর্ট তাদের হাতেও এসেছে। প্রিয় পাঠক, এসম্পর্কে আমাদের কোনো মন্তব্য নাই। আমরা জামায়াতের কর্মীদের সংখ্যা হ্রাস বা বৃদ্ধির বিষয়ে কিছু জানি না।
ওপরে উল্লেখিত পরিসংখ্যান যদি সঠিক হয় তাহলে একথা বলতেই হবে যে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় ৫ জন নেতার ফাঁসি এবং ৩ নেতার কারাদণ্ড ও ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে থামাতে পারেনি।