নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে এর আগে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগ গঠন এবং এর কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। এ বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অণুবিভাগ’ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে বৈঠক হয়েছে। এই আইনে সরকার প্রয়োজনবোধে যেকোনো ব্যক্তির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বাতিল করতে পারবে।
দীর্ঘদিন এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শেষে সরকার এ মর্মে আইন করতে যাচ্ছে যার নাম ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০২৩ সম্প্রতি খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে মন্ত্রিসভায়। এখন শুধু আইনে রূপ দেয়া বাকি। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হলে এনআইডি দেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়। নির্বাচন কমিশন করবে কেবল ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের ভোটার তালিকা। এর আগে, গত বছরের ১০ অক্টোবর জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনের খসড়া অনুমোদন দিয়েছিল মন্ত্রিসভা।
এতে ক্ষমতা খর্ব বা কমে যাওয়ায় নির্বাচন কমিশন-ইসি কী সরকারের ওপর গোস্যা হয়েছে! এক কথায় হ্যাঁ বা না বলার সুযোগ নেই। কারণ, ইসির অভিমানের সুযোগ নেই। তাদের করণীয় শুধু সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। ভেতরে নানান কথা থাকলেও তা প্রকাশ্যে বলার অবস্থা নেই ইসি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তারা আগে যে কাজটি করতেন আইন হওয়ার পর সেই কাজটি করবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। আইন পাসের পর নির্ধারিত তারিখ থেকে নতুন নিবন্ধকের অফিসের মাধ্যমে শুরু হবে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধকের কার্যক্রম। এ জন্য নিবন্ধকের কার্যালয় থাকবে। এ অফিসের প্রধান হবেন নিবন্ধক। জাতীয় পরিচয় নিবন্ধনসংক্রান্ত তথ্যাদি ইসি থেকে নতুন নিবন্ধকের দফতরে স্থানান্তর হবে। এখন যাদের এনআইডি আছে, সেগুলো কার্যকর বা চলমান থাকবে। বর্তমান নিয়মে শুধু ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীরা এনআইডি করতে পারেন। প্রস্তাবিত আইনে যেকোনো বয়সে এনআইডি করা যাবে।
কেবল এনআইডি নয়, কোনো সরকার যখন যে আইন করে এর উপকার, উদ্দেশ্য, লক্ষ্য নিয়ে কিছু যুক্তি দেয়। এনআইডি নির্বাচন কমিশন থেকে স্বরাষ্ট্রে নেয়ার বিষয়েও পর্যাপ্ত যুক্তি আছে সরকারের। প্রস্তাবিত আইনে যেকোনো বয়সে এনআইডি করা যাবে। লক্ষ্য হলো- ধীরে ধীরে এই একটি পরিচয় নম্বরে সব তথ্য রাখা। এসব শুনতে মন্দ লাগে না। উপজেলা নির্বাচন অফিসে এনআইডি সংশোধনে যে চরম হয়রানির শিকার হতে হয়; এখন তার পরিবর্তন হবে কি না প্রশ্ন আছে। এক পাসপোর্ট নিয়ে যে মাত্রার ভোগান্তি পেতে হয়; এর সাথে এখন এনআইডি যোগ হলে কী অবস্থা দাঁড়াতে পারে তা সহজে অনুমেয়। লক্ষণীয় ব্যাপার- নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে লা-জবাব। কোনো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে না। নির্বাচন সচিব মো: জাহাঙ্গীর আলম, একবারে পিআরও-এর মতো বলেছেন, সরকার আইন করে নির্বাচন কমিশনকে এনআইডির দায়িত্ব দিয়েছিল। এখন সেই আইন সংশোধন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে দিচ্ছে। এতে নির্বাচন কমিশনের কিছু বলার নেই।’
তার ‘কিছু বলার নেই’ কথাটির মধ্যে যে কত অব্যক্ত কথা ও কষ্ট লুকানো, তা জানেন ইসির সংশ্লিষ্টরা। সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে। ২০০৭ সাল থেকে এনআইডি তৈরি ও সরবরাহের কাজ ছিল নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এনআইডি সেবা কার্যক্রম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের হাতে দেয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে শুরু থেকে ইসি বলছিল, যে কাজ কমিশন করছে; সেটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর হলে নতুন জনবল ও অবকাঠামো প্রয়োজন হবে। এতে খরচ হবে সরকারের কোটি কোটি টাকা। এ ছাড়া ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়ে কমিশন নাগরিকদের ৩২ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে। ফলে এনআইডি সেবা কার্যক্রম কমিশনের হাতে থাকা যুক্তিযুক্ত।
২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা হয়েছে। তার উপজাত হিসেবে প্রায় আট কোটি তিন লাখ ভোটারের তথ্যসমৃদ্ধ ভোটার তালিকা থেকে আইন করে এনআইডি দেয়া শুরু হয়। সেই দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাচন কমিশনকে। সরকার এখন এ দায়িত্ব আর ইসির হাতে রাখছে না। ইসির ভেতরে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে এ নিয়ে ক্ষোভ চলছে। এমন কিছু একটার আয়োজন চলা অবস্থাতে সিইসিসহ চার কমিশনারকে স্মারকলিপি দিয়েছিলেন তারা। বলেছিলেন, এনআইডি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের শ্রমে-ঘামে করা একটি কাজ। কাজটি এখন হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার বেদনায় আক্রান্ত তারা। তুলনামূলক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের হাত থেকে এনআইডির দায়িত্ব নিয়ে নেয়ার মধ্যে কী রহস্য থাকতে পারে- তাতে কিছু সংশয় থাকা স্বাভাবিক। এনআইডির সাথে ভোটার তালিকার ব্যাপক সম্পৃক্ততা। এ নিয়ে ভোটার তালিকা ম্যানুপুলেট করার পর্যাপ্ত সুযোগ আছে। এনআইডির দায়িত্ব ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার কথা চাউর হয়েছে বছর দুয়েক আগে।
২০২১ সালের ১৭ মে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম ইসির পরিবর্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে ন্যস্ত করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এক সপ্তাহ পর ২৪ মে ইসি সচিব ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ সচিবের কাছে চিঠি পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। চিঠিতে বলা হয়েছিল, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সুরক্ষা সেবা বিভাগ ওই দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এনআইডি নিবন্ধন-সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম সুরক্ষা সেবা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। ওই চিঠিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন-সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ‘রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬’ এর রুল ১০ অনুসরণে এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠিতে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন-২০১০’ এ ‘নির্বাচন কমিশন’-এর পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্তকরণসহ প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এ ছাড়া সুরক্ষা সেবা বিভাগের এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনায় বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। একই বছরের অর্থাৎ ২০২১ সালের ৮ জুন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কার্যক্রম নিজেদের কাছে রাখার বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় ইসি।
ওই চিঠিতে কমিশন জানায়, এনআইডির কাজ অন্য বিভাগে গেলে ভোটার তালিকা করা ও তা হালনাগাদ এবং নির্বাচনসহ বিভিন্ন সমস্যা হবে। সরকারের এ পদক্ষেপকে তখন ‘সংবিধানবিরোধী’ বলেও আখ্যা দেয় কমিশন। ইসির সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিশনকে আরেকটি চিঠিতে জানায়, ১৭ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাঠানো পত্রের আলোকে সরকার এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন সেটি কার্যকরের চূড়ান্ত পর্যায় চলছে। এনআইডি নামের কাগজটি এখন আর কেবল ভোটের বিষয় নয়। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রমাণে এবং বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা পেতে এটি জরুরি। সরকারি সব অনলাইন সুবিধা, ড্রাইভিং লাইসেন্স করা ও নবায়ন, পাসপোর্ট করা ও নবায়ন, সম্পত্তি কেনাবেচা, আয়করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন প্রাপ্তি, বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন, ই-পাসপোর্ট, ব্যাংক হিসাব খোলা, ব্যাংক ঋণগ্রহণ, সরকারি ভাতা উত্তোলন, সহায়তা প্রাপ্তি, বিআইএন, শেয়ার-বিও অ্যাকাউন্ট, ট্রেড লাইসেন্স, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, বীমা স্কিম, ই-গভর্নেন্স, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ, মোবাইল সংযোগ, হেলথ কার্ড, ই-ক্যাশ, ব্যাংক লেনদেন ও শিক্ষার্থীদের ভর্তিসহ বহু কাজে এনআইডি লাগছে। গেলবার থেকে রেলের টিকিট কাটতেও তা আবশ্যক করা হয়েছে।
এত সব আবশ্যকতার কারণে নকল এনআইডি তৈরিও হচ্ছে। এর পেছনে বিভিন্ন পর্যায়ে সুসংগঠিত চক্র কাজ করে। ওই চক্র যাদের এনআইডি কার্ড দরকার তাদের সংগ্রহ করা থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশনের সার্ভারে তথ্য প্রবেশ করানোর পর্যন্ত সব পর্যায়ে লোকজন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মাঝে মধ্যে তাদের হাতে এ চক্রের কিছু সদস্য ধরাও পড়ে। এ চক্রের হোতাদের ধরতে পুলিশের সাথে নির্বাচন কমিশনও অভিযানে নেমেছে কখনো কখনো। ফল তেমন আসেনি। এখন এনআইডির দায়িত্ব ইসির হাত থেকে স্বরাষ্ট্রে যাওয়ার পর আরো কী কাণ্ডকীর্তি ঘটে বা ঘটবে- এ উদ্বেগও আছে নানা মহলে।
এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- সরকার কেন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এর পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত রয়েছে? এ হস্তান্তরের মাধ্যমে ১১ কোটির বেশি নাগরিকের বিভিন্ন তথ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে, যা রাজনৈতিকভাবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া এনআইডি দেয়ার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের শর্ত জুড়ে দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি ও নানা ধরনের কারসাজি করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সর্বোপরি, মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পেলে, সরকার তা ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নানা অজুহাতে এনআইডি থেকে বঞ্চিত করতে পারবে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো- যেহেতু এনআইডি ভোটার-আইডি হিসেবে ইভিএমে ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তাই এটি ঘিরে বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে ভোটের ফল প্রভাবিত করার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নূরুল হুদা কমিশনের সহায়তায় আগের রাতের ভোটে ‘নির্বাচিত’ সরকারের পক্ষে তা করা কোনোভাবে অসম্ভব নয়। এ ছাড়া ‘ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিআইটি) বিহীন ইভিএম ব্যবহার করে যা নূরুল হুদা কমিশনের আরেকটি ‘অবদান’ ‘ডিজিটাল টেম্পারিংয়ের’ মাধ্যমে ভোটের ফল পাল্টে দেয়ার আশঙ্কা তো রয়েছেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com