একদিকে তীব্র ডলার সংকট। অন্যদিকে মুদ্রাটির বিপরীতে টাকার মানও কমছে। অর্থাৎ ডলারের দামও বাড়ছে। মূলত চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হওয়ায় ডলারের দাম বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম আবারও বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ডলার বিক্রি করা হচ্ছে ১০৯ টাকায়। সবশেষ ১৪ই জুন আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলার ১০৯ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে।
এখন পর্যন্ত এটাই ডলারের সর্বোচ্চ রেট। এক বছর আগে এ দাম ছিল ৯২ টাকা ৮০ পয়সা। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করায় টান পড়ছে রিজার্ভেও। বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৬ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয়েছে।
এর ফলে রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৮৩ বিলিয়ন ডলারে।
সূত্রমতে, মুদ্রার বিনিময় হারের ওঠানামা বিভিন্নভাবে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি করে। বিনিময় হারে হঠাৎ করে কমে গেলে সরকারের ঋণ বাড়তে পারে। যদিও বাংলাদেশে বিগত কয়েক বছর ধরে বিনিময় হার স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু টাকার সামপ্রতিক মান হারায় বিভিন্নভাবে আর্থিক ভারসাম্য এবং ঋণের সামগ্রিক পরিমাণকে প্রভাবিত করছে। এ ছাড়া সরকারের রাজস্ব আদায় এবং ব্যয় উভয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডলারের বাজার মূল্য ধরে বাজেট দেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু ডলারের মূল্য ওঠানামা করায় অর্থমন্ত্রীর হিসাব হেরফের হয়ে যায়। এতে অর্থনীতিতে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়। সরকার ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করলেও খুব একটা কাজ হয়নি। বরং উল্টো হয়েছে। এজন্য ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের।
এদিকে গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটে এ অবস্থার তৈরি হয়। সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতে সংকট কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়। এর ফলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। ফলে কয়েক মাসের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম ৮৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকায় উঠেছিল।
জানা গেছে, ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি আরোপ করার পর এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আসছে, তার চেয়ে আমদানি খরচ কিছুটা কমেছে। তবে বিদেশি সেবা ও পরিবহন খরচ এবং বিদেশ থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধে যে খরচ হচ্ছে, তাতে প্রতি মাসে ডলারের আয়-ব্যয়ে বড় অঙ্কের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
এদিকে রপ্তানি আয় সময়মতো না আসায় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে পোশাক খাতের অনেক উদ্যোক্তাকে ডলার দেয়া বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ইডিএফ’র ৭০০ কোটি ডলার বা ৭ বিলিয়ন ডলারের তহবিল নেমে এসেছে ৪৪৯ কোটি ডলার বা ৪.৪৯ বিলিয়ন ডলারে। ফলে পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের ঋণপত্র খোলার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমতে থাকলে ঋণ পরিশোধে সরকারের চাপ বাড়বে। এতে বাড়বে ভর্তুকির পেছনে ব্যয় ও প্রকল্পের ব্যয়। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি হতে পারে। এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা সামগ্রিক আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সরকারের কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে।
সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ২০১২ সালের জুন শেষে দেশে ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ৮১.৮৭ টাকা। ২০২১ সালের জুন শেষে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৮৪.৮০ টাকা। এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়ন হয় ৩.৫৮ শতাংশ। বিপরীতে গত এক বছরে টাকার মান কমেছে ২৫.৫৮ শতাংশ। ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১০৯ টাকা। ডলারের দাম বাড়ায় ইতিমধ্যে সরকারের আর্থিক বোঝা বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
টাকার অবমূল্যায়নের কারণে সরকারের প্রকল্প ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করে নীতি বিবৃতিতে বলা হয়, অনেক সরকারি প্রকল্প, বিশেষ করে বড় (মেগা) প্রকল্প আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। এভাবে টাকার মান কমলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে।একই কারণে সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। পরের দুই অর্থবছরে এই ঋণ বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ৩৬ হাজার ৬০০ ও ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মান ১০ শতাংশ কমলে আগামী অর্থবছর শেষে সরকারি ও সরকারি নিশ্চয়তাযুক্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪০ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ প্রতিবছর বাড়ছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার ১৫০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ পরিশোধ করেছে। চলতি বছর সেটি বেড়ে ২১০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে। আগামী দুই বছর যথাক্রমে ২৪০ ও ২৬০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে। গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের ৫০ শতাংশই ডলারে ছিল। এ ছাড়া ২১ শতাংশ বিদেশি ঋণ জাপানি ইয়েনে, ১৫ শতাংশ ইউরোতে ও ৩ শতাংশ ব্রিটিশ পাউন্ডে ছিল। এমন তথ্য উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত ও তারল্য সংকট এড়াতে দক্ষ ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থাপনা জরুরি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে প্রবাসী আয় আসা ও রপ্তানি আয় আসা বাড়বে। ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করলে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে। এ ছাড়া পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে পাইপলাইনে থাকা সহায়তা ছাড় করাতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।