দেশজুড়ে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ। জ্বর, ডায়রিয়ার চিকিৎসা নিতে এসেও অনেকের ধরা পড়ছে ডেঙ্গু। ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী এখন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছেন নতুন রোগী। এসব রোগীর বেশির ভাগই গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে নতুন করে ৯৮ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। ভর্তি রোগীদের একটা বড় অংশই রাজধানীর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যাত্রাবাড়ী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার।
সরজমিন মুগদা হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় হাসপাতালে বেড়েছে রোগী ও স্বজনদের চাপ। সিঁড়ি, লিফ্ট থেকে শুরু করে হাসপাতালের সর্বত্র এই বাড়তি রোগীর চাপ দেখা গেছে।
হাসপাতালের ১০ তলায় মেডিসিন বিভাগের পুরো জায়গা জুড়ে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নির্ধারিত বেডের চেয়েও দ্বিগুণ রোগী ভর্তি হওয়ায় সেখানে মেঝেতেও শয্যার ব্যবস্থা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সিঁড়ির-লিফটের কিনারাও ফাঁকা নেই। সেখানেও রয়েছে রোগী।
সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দেয়ার চেষ্টা করছেন ডাক্তার-নার্সরা। রোগী ও স্বজনদের উপচে ভিড় ওয়ার্ড জুড়ে। হাসপাতালটির ৮ তলায় শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হয়। ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ায় সেখানেও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া তিন তলায়ও ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশব্যাপী ডেঙ্গু পরিস্থিতি বাড়ার কারণে হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। বর্তমানে ৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে সক্রিয় বেড রয়েছে ৪২০টি। তবে এর বিপরীতে রোগী ভর্তি রয়েছে ৯২৮ জন। এর মধ্যে শুধু ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীই ২৭১ জন। ৭০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুও ভর্তি রয়েছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের তিনটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
পাঁচ মাসের শিশু আয়াত। এক সপ্তাহ আগে জ্বর আসে। পরে স্থানীয় ডাক্তার দেখান মা আছিয়া বেগম। শারীরিক অবস্থা ভালো না হলে সোমবার মুগদা হাসপাতালে নিয়ে আসেন তিনি। পরে তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। আছিয়া বেগম জানান, তিনি জুরাইন এলাকায় থাকেন। তাদের এলাকাটি ঘনবসতিপূর্ণ। বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে। তাদের এলাকার অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। যাত্রাবাড়ীর ধলপুর এলাকার বাসিন্দা নাঈম (১৫)। গত শুক্রবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে মঙ্গলবার হাসপাতালে ভর্তি হয়।
নাঈম বলেন, বিকালে হঠাৎ করে জ্বর জ্বর মনে হয়। পরে রাতে জ্বর আসে। এরপর আর ভালো হয় নাই। ডাক্তার দেখানোর পর ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। আলী আকবর নামের ডেমরা এলাকার আরেক রোগী জানান, এক সপ্তাহ আগে জ্বর আসার পর স্থানীয় ডাক্তারের কাছে যান। পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করার পর পজিটিভ এলে হাসপাতালে ভর্তি হন। তার রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণও নামছে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের শারীরিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে মুগদা হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ড. মো. মনজুরুল হক মানবজমিনকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশি জ্বর হচ্ছে না। তবে প্রায় সবার ডায়রিয়ার লক্ষণ পাচ্ছি। এতে তাদের পানিশূন্যতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ডায়রিয়া নিয়ে আসা রোগীদেরও আমরা ডেঙ্গু টেস্ট করাচ্ছি। এতে অনেকেরই ডেঙ্গু পজিটিভ আসছে। হাসপাতালে যেসব রোগী দেরি করে আসছেন তাদের অবস্থাই গুরুতর বলে তিনি উল্লেখ করেন। যারা আসছেন তাদের রক্ত বমি, কালো পায়খানার চেয়ে পানি শূন্যতা হয়ে পেশার কমে যাওয়ার লক্ষণই বেশি। তাই তাদের প্রচুর স্যালাইন দিতে হচ্ছে।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. নিয়াতুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, পুরো বাংলাদেশের চেয়ে এখন আমাদের হাসপাতালেই সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন। আমরা তাদের জন্য ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ড বিস্তৃত করেছি। নারীদের আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী ভর্তি হচ্ছেন।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার কারণে হাসপাতালটিতে কিছুটা চিকিৎসক সংকট তৈরি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বাড়তি ছয়জন চিকিৎসক দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে চারজন কাজে যুক্ত হয়েছেন। বাকি দু’জন অনুপস্থিত। ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরিক্ষায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে উল্লেখ করে হাসপাতাল পরিচালক বলেন, প্রতিদিন রোগীদের সাড়ে তিন হাজারের মতো বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। এতে হাসপাতালের কিট সংকট তৈরি হয়েছে।
এই মুহূর্তে আমাদের যে কিট রয়েছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ ১০ দিন চলতে পারবো। আমরা আমাদের কিটের চাহিদার কথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়েছি। ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষায় ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন এই পরিচালক। এছাড়া সবাইকে সব সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো ও জ্বর-মাথাব্যথা, বমি হওয়া, পাতলা পায়খানা হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কথা জানান। ডেঙ্গু ধরা পড়লে দেরি না করে দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শও দেন এই চিকিৎসক।