প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দুর্নীতি উন্মোচন করতে গিয়ে দেশে সাংবাদিক হত্যার পাশাপাশি নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে দেশে ১০১ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ২২৬ জন সাংবাদিক। গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই চার মাসে হত্যা করা হয়েছিল তিনজন সাংবাদিককে।
সর্বশেষ গত বুধবার জামালপুরে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি নাদিমকে হত্যা করা হয়। গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১৫ মাসে হত্যার শিকার হন চারজন সাংবাদিক।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা প্রতিবেদন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অপরাধ পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বাধীন সাংবাদিকতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকরা হত্যা, হুমকি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে।
কারণ সাংবাদিকরা সব সময় দেশ ও জনগণের পক্ষে কথা বলেন।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলছে। পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ বছরে দেশে অন্তত ৩০ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। দীর্ঘসূত্রতায় ঝুলে আছে এসব হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া।
আসকের পাঁচ মাসের প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে : আসকের প্রতিবেদন বলছে, পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত পাঁচ মাসে দেশে ১০১ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। রাজনৈতিক দলের নেতা, পৌর মেয়র, ইট ভাটার মালিক, অজ্ঞাত মোবাইল থেকে ফোন করে প্রাণনাশের হুমকির দেওয়া হয়েছে সাংবাদিকদের। এ ছাড়া ইউপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষার্থী এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কাছ থেকে সাংবাদিকরা হুমকি পাচ্ছেন।
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী কর্তৃক নির্যাতন, অপহরণ ও বোমা হামলার শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দ্বারাও নির্যাতন ও হুমকির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
গত বছরের প্রথম ছয় মাসের সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্য বিশ্লেষণ করে আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সময় রাজধানীতে ১২টি ঘটনায় ২৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বরিশালে চারটি ঘটনায় ২৩ জন এবং নারায়ণগঞ্জে পাঁচটি ঘটনায় আরো পাঁচজন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সাম্প্রতিক হত্যা : আসকের হিসাবের বাইরে গত ১৪ জুন রাতে জামালপুরে বকশিগঞ্জ উপজেলার পাথাটিয়া এলাকায় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে ফেলে হত্যা করা হয় সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি নাদিমকে।
তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের জামালপুর প্রতিনিধি ছিলেন। মূলত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় তাঁকে হত্যা করা হয়।
গত বছর তিন সাংবাদিক নিহত : দেশে গত বছর হত্যা করা হয় তিনজন সাংবাদিককে। এর মধ্যে গত বছরের ১৩ এপ্রিল পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায় গুলি করে হত্যা করা হয় সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে। গত বছরের ৫ জুন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় হত্যা করা হয় সাংবাদিক আবু জাফর প্রদীপকে আর ৩ জুলাই পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হত্যা করা হয় কুষ্টিয়ার স্থানীয় সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেলকে।
সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি নাদিম হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার জেরে সাংবাদিকদের ওপর চলমান হামলা, মামলা, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বাড়ছে। এর সর্বশেষ শিকার গোলাম রাব্বানি নাদিম। নাদিম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাাংবাদিকদের সুরক্ষায় সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সাংবাদিক গোলাম রাব্বানি নাদিম হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করে বিচারের দাবি জানিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)। গতকাল প্যারিসভিত্তিক সংস্থাটি এক বিবৃতিতে এই বিচার দাবি করে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী যে বা যারাই হোক, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/17/1290633