অভাবী সংসারে কিছু রোজগারের আশায় উন্নত জাতের একটি শাহিওয়াল গাভি কিনেছিলেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার আমেনা বেগম। বছরখানেক আগে বেসরকারি একটি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে গাভিটি কেনেন কামাতকাজলদীঘি ইউনিয়নের দফাদারপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা। আর কিছুদিন পরই এটি বাছুরের জন্ম দিত। এর মধ্যে ত্বকের বিশেষ একটি রোগ লাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হয় গাভিটি।
স্থানীয় একাধিক পশু চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করান। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। ১০ দিন ভুগে মারা যায় গরুটি। গাভির শোকে এখন মুষড়ে পড়েছেন আমেনা।
শুধু আমেনা বেগম নন, উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে গরুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাবে অনেক খামারি ও কৃষক বিপাকে। সুচিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে আক্রান্ত গরু।
আমেনা বেগম বলেন, ‘আমি নিজের সন্তানের মতো গরুটারে পালছি। কম কইরা হলেও এক লাখ টাকা দাম হইত।
এখন ঋণ শোধ করমু কী দিয়া? ঋণের চিন্তায় ঘুমাইতে পারি না। এই গাভির কথা মনে হইলেই চোখে পানি চইলা আসে।’
গাভিটি মারা যাওয়ার পর আমেনার ছেলে আমিনার রহমান অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর এই যুবক ছেলেই ছিল আমিনার জীবন-জীবিকার অবলম্বন। এটাও এখন তাঁর মনঃকষ্টের কারণ।
গাভিটির রোগের বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় পশু চিকিৎসক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। জেলা যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি গ্রামে গবাদি পশুর চিকিৎসা করছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘গরুর অবস্থা দেখে আমি তাদের বলেছিলাম যে উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু তারা সেই পরামর্শ না শুনে স্থানীয়ভাবে অন্যদের দিয়ে চিকিৎসা করায়।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসখানেক আগে সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ে দেখা দেয় গরুর প্রাণঘাতী এই রোগ। গ্রাম থেকে গ্রামে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে রোগটি। গত এক মাসে জেলার পাঁচ উপজেলায় বহু গরু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গরুপ্রতি চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। এর পরও সুস্থ করা যাচ্ছে না। সুচিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে গরু। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে সদর উপজেলার কামাতকাজলদীঘি ইউনিয়নসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি গরু মারা গেছে।
রোগটির বিষয়ে গরুর মালিক ও খামারিদের ভাষ্য, শুরুতে গরুর সারা শরীরে বসন্তের মতো গুটি উঠছে। তারপর হাঁটু, গোড়ালি ও গলা ফুলে যাচ্ছে। গলায় পানি জমছে। জ্বর আর প্রচণ্ড ব্যথায় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয় আক্রান্ত গরু। অনেক সময় মুখ দিয়ে লালা পড়ে। কেউ কেউ অন্যান্য সুস্থ গরুকে এ রোগ থেকে রক্ষা করতে আক্রান্ত গরুকে মশারি দিয়ে আলাদা করে রাখছে। কিন্তু এর পরও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না।
খামারিদের অভিযোগ, প্রাণিসম্পদ অফিসের চিকিৎসকদের ডাকলে সাড়া দেন না। আর এলেও তাঁদের বড় অঙ্কের ফি দিতে হয়। নিরুপায় হয়ে তাঁরা গ্রামের পশু চিকিৎসকদের মাধ্যমে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা করাচ্ছেন। গ্রাম্য চিকিৎসকরা যে যাঁর মতো ওষুধ প্রয়োগ করছেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে বিপত্তি ঘটছে।
সদর উপজেলার গলেহাপাড়া এলাকার গরুর খামারি মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। গরুটি লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় মারা গেল।’
তিনি বলেন, ‘পশু হাসপাতালে নিলে সার্জনরা গরু না দেখেই ওষুধ লিখে দেন। আর বাড়িতে তাঁদের ডাকলে এক হাজার টাকা ভিজিট দিতে হয়। এমনিতে অভাব চলছে, এর মধ্যে গরুটি মারা যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছি।’
ওই এলাকার নার্গিস আক্তার বলেন, ‘গরুই হলো আমাদের সম্পদ। গরু লালন-পালনের পর বিক্রি করে আমরা সংসারের কাজে লাগাই। মেয়ের বিয়েতে খরচ করি। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিই। কিন্তু লাম্পি স্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার গরুটি মারা গেল।
আমাদের এলাকায় প্রতি বাড়িতেই দু-একটি করে গরু এই রোগে আক্রান্ত, কিন্তু সুচিকিৎসা পাচ্ছি না। প্রাণিসম্পদ অফিসের লোকজনও খবর নিতে আসে না।’
মামুনুর রশিদ নামের অন্য একজন বলেন, ‘বর্তমানে সব এলাকায় লাম্পি স্কিন রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েও গরুগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। প্রতিবছরই এই রোগে গরু মারা যাচ্ছে, কিন্তু রোগের প্রতিষেধক বা প্রতিকারে সরকারি উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি যারা ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের জন্য সহায়তার উদ্যোগও নেই।’
কামাতকাজলদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল প্রধান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ৩০০ থেকে ৪০০ গরু এই রোগে আক্রান্ত। অন্যান্য এলাকা মিলিয়ে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা হাজারের বেশি হবে। এই রোগের প্রতিকারে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। আমাদের ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে এই রোগে গরু আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে একটি গরু মারা যাওয়ায় এক ব্যক্তি ওটাকে রাস্তার পাশে ফেলেই চলে যান। আমরা পরে গরুটিকে মাটিচাপা দেওয়ার ব্যবস্থা করি।’
লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাবে জেলার রাজনগর, নগরকুমারীসহ বড় বড় হাটে গত বছরের তুলনায় পশুর আমদানি অনেক কমেছে। রাজনগর পশুর হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার পশুর হাটে গরুর আমদানি গত বছরের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। মূলত লাম্পি স্কিন রোগ সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় পশুর হাটগুলোর এই পরিস্থিতি। গরুর দামও কিছুটা কমেছে বলে তিনি জানান।
পঞ্চগড় জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুর রহিম বলেন, লাম্পি স্কিন ভাইরাসজনিত রোগ। এটি মশা-মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। লাম্পি স্কিন রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকলেও ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। আতঙ্কিত না হয়ে মশা-মাছি থেকে গরুকে নিরাপদ রাখতে হবে। গরুর শরীর ও পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘কতগুলো গরু আক্রান্ত, এর সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে সীমান্ত এলাকায় এটি বেশি ছড়াচ্ছে। দু-একটি গরু মারাও গেছে। এ ছাড়া গ্রামের ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের অফিসের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জানান, জেলায় এবার কোরবানির পশুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৯০ হাজার। পশু রয়েছে প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজার। চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পশু প্রস্তুত।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/06/17/1290643