তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে ২০১৫ সালে ভেসে আসা সিরীয় শরণার্থী শিশু আয়লান কুর্দির প্রাণহীন দেহ বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। তার পর কেটে গেছে আট বছর। ভূমধ্যসাগরে আজও আয়লানের মতোই শত শত শিশুর সলিলসমাধির খবর আসছে। তবে এসব খবর এখন আর পাশ্চাত্যের বিবেককে নাড়া দেয় না।
সর্বশেষ বুধবার একটি মাছ ধরার নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে গ্রিসের উপকূলে ৭৮ জন মারা গেছেন। তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে। নৌকাটিতে অন্তত ১০০ শিশুও ছিল। নৌকাটি ভূমধ্যসাগরের অন্যতম গভীর অংশ পাড়ি দিচ্ছিল। ইতালি ও গ্রিসের উপকূলরক্ষীদের টহল এবং অবৈধ পুশব্যাক এড়াতে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকাগুলো এভাবেই বড় ঝুঁকি নিচ্ছে।
শরণার্থী প্রতিরোধ করতে গ্রিস সরকার তুরস্ক সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু গ্রিসই নয়, ইউরোপজুড়ে সরকারগুলো উঁচু প্রাচীর এবং কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ঠেকাতে চাচ্ছে। তারা তৃতীয় কোনো ‘নিরাপদ’ দেশে আশ্রয়প্রার্থীদের স্থানান্তরকে নৈতিক কাজ হিসেবে বিবেচনা করছে। এভাবে ইউরোপকে একটি দুর্গে পরিণত করা হচ্ছে, যেখানে শরণার্থীদের জন্য কোনো স্থান নেই।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রতিবেদন অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে অন্তত ৪৪১ শরণার্থী মধ্য ভূমধ্যসাগরে ডুবে গেছেন। ২০১৭ সালের পর থেকে কোনো ত্রৈমাসিকে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা এটি। সংস্থাটির মঙ্গলবার প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত বছর মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার অভিবাসন রুটে প্রায় ৩৮০০ অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। ২০১৭ সালের পর থেকে এটা সর্বোচ্চ সংখ্যা। আইওএমের হিসাবে, ২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
এত মৃত্যু সত্ত্বেও ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য নিরাপদ ও আইনি পথ তৈরির জন্য কোনো প্রকৃত উদ্যোগ নেয়নি। বিপরীতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও বিধিনিষেধ এবং পুশব্যাকের মতো পদক্ষেপ দেখা গেছে।
যেমন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে লিবিয়ান কোস্টগার্ড এবং গ্রিক কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টারত শরণার্থী নৌকাগুলোকে পুশব্যাক করে বা ফিরিয়ে দেয়। এসব পদক্ষেপ ইউরোপে সুরক্ষা চাওয়াকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটিসহ দাতব্য সংস্থাগুলো বলেছে, ভূমধ্যসাগরে বারবার প্রাণহানি ইউরোপে সুরক্ষা খোঁজার জন্য শরণার্থীদের আইনি পথ সংকুচিত হওয়ার চিত্রই তুলে ধরে।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, বর্তমানে বিশ্বে ১১ কোটি মানুষ উদ্বাস্তু। এক বছরে বেড়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ। মূলত বিশ্বের দরিদ্র দেশের খুব ছোট একটি অংশ যে কোনো উপায়ে ইউরোপ মহাদেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এ মহাদেশের নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সাধারণ মানুষের হৃদয়ের পরিবর্তন ছাড়া তাদের জন্য সুখবর মিলবে না।
শরণার্থী সংকটের কারণ যুদ্ধ, সংঘাত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, চরম দারিদ্র্য এবং বৈশ্বিক অসমতা, বিভিন্ন দেশের নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। এসবই একবিংশ শতাব্দীর ভূরাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এসব সংকটে ইউরোপেরও অনেক দায় রয়েছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান ও সিরিয়ার পাশাপাশি পাকিস্তান, ভারত এবং বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ সাগর পথে ইউরোপে প্রবেশের ঝুঁকি নিয়ে থাকে। আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত অনেক মানুষও একই পথ বেছে নেন।
ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর বিশ্বে বাংলাদেশিদের আশ্রয় প্রার্থনা ৮৮ শতাংশ। ২০২২ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার ৯০০ জনে। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশিদের সিংহভাগ ইউরোপের দেশে প্রবেশ করে শরণার্থী অথবা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকে। আর ইউরোপের দেশে প্রবেশের উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, শরণার্থী সংকট রোধ করার জন্য অবশ্যই কাঠামোগত এবং রাজনৈতিক কারণকে মোকাবিলা করতে হবে।
নরওয়ের খ্রিস্টান মিশলসেন ইনস্টিটিউটের গবেষক হেইডি মোগস্টাড আলজাজিরায় এক নিবন্ধে লিখেছেন, অস্বস্তিকর বাস্তবতা হলো ইউরোপীয়দের কাছে সব জীবন সমান নয়।
তিনি লিখেছেন, অর্থনৈতিক অভিবাসীদের ব্যাপারে ইউরোপের যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তা অবশ্যই দূর করতে হবে। একটি নতুন দেশে উন্নত জীবন চাওয়ায় নৈতিকভাবে কিছু ভুল নেই। ১৮২০ থেকে ১৯২০-এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে উন্নত জীবনের সন্ধানে গিয়েছিলেন ইউরোপের লাখ লাখ নাগরিক। তাঁরা তখন ঠিক কাজটিই করেছিলেন। এটি তখন গ্রহণযোগ্য ছিল এবং এখনও তা গ্রহণযোগ্য হতে হবে।