আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ হয়, সে লক্ষ্যে সরকারের ওপর ধীরে ধীরে বিদেশি চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এ নিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে। সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বাড়ছে নানামুখী চাপ। এ নিয়ে দেশি-বিদেশি শক্তিগুলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বেশ তৎপর। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন। পর্দার আড়ালেও চলছে দৌড়ঝাঁপ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন-পূর্ব পরিস্থিতি বিশেষ করে তা অংশগ্রহণমূলক হওয়ার পরিবেশ আছে কিনা তা মূল্যায়নে জুলাইয়ে একটি স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দল পাঠাচ্ছে ইইউ।
সে সময় সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তাদের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সরকার কোনো চাপে নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নত ও শক্তিশালী করার পরিবর্তে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলির বিরুদ্ধে কূটনৈতিক দ্বন্দে নেমেছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এমনটাই মনে করছেন দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এদিকে চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে জাতিসংঘের পিস অপারেশন বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে বাংলাদেশ সফরে আসছেন।
সফরে তিনি বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক সম্মেলনে যোগ দেবেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশ বড় ভূমিকা রেখে আসছে। ওদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এর ওয়েবসাইটে সংগঠনের চিফ এফভোকেসি অফিসার ব্রুনো স্ট্যাগনো লিখেছেন, জাতিসংঘের পিস অপারেশন বিভাগের প্রধান আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রুয়ার উচিত তার আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর নির্যাতনের বিষয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করা। তিনি এমন এক সময়ে বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন যখন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, অধিকার কর্মী ও জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে টার্গেট করছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হয়রানি করছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো, বিশেষ করে সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) দীর্ঘদিন ধরেই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যে নতুন ভিসানীতি ঘোষণা দিয়েছে। সে অনুযায়ী আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হতে যারাই বাধা দেবে, তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করবে দেশটি। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঢাকা সফরে এসে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। এছাড়া ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার মধ্যেই নির্বাচন ইস্যুতে দেশটির প্রেসিডেন্টের কাছে চিঠি দেন ৬ প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান। চিঠিতে বাংলাদেশে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
এদিকে গত ১২ জুন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্যরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেলকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। একইসঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ ও চলমান রাজনৈতিক সংকটে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। চিঠিতে তারা আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান।
চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য গণতান্ত্রিক স্থান সংকুচিত হয়েছে এবং এই সরকার মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষমতা সুসংহত করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলার আশ্রয় নিচ্ছে সরকার। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণœ হচ্ছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা দাবি করেন, বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) হেফাজতে নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। নির্যাতন শুধুমাত্র সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপরেই হয় না, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- এবং জোরপূর্বক গুমের উচ্চ হার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, আমরা বাংলাদেশের আসন্ন ১২তম সাধারণ নির্বাচনের উপর ফোকাস রাখার বিষয়ে জোর দিতে চাই। ২০২৩ সালের শেষের দিকে বা ২০২৪ সালের শুরুতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চিঠিতে দাবি করা হয়, কারচুপি, কারসাজি এবং ভোটারদের অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দশম সাধারণ নির্বাচন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি বর্জন করেছিল। অপরদিকে ১১ তম ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ হিসাবে পরিচিত। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা হচ্ছেন, ইভান স্টেফানেক (ইপিপি, স্লোভাকিয়া), মাইকেলা সোজড্রোভা (ইপিপি, চেক প্রজাতন্ত্র), আন্দ্রে কোভাতচেভ (ইপিপি, বুলগেরিয়া), কারেন মেলচিওর (রিনিউ, ডেনমার্ক), জাভিয়ের নার্ট (রিনিউ, স্পেন) এবং হেইডি হাউটালা (গ্রিনস/ইএফএ, ফিনল্যান্ড)।
আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশি চাপ থাকলেও তা প্রত্যাখ্যান করছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন খুব স্পষ্ট করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সরকার কোনো ধরণের বিদেশি চাপে নেই। আর সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার বদ্ধপরিকর। সে কারণেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছ ব্যলট বাক্স ও ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। যদিও গত ২৪ মে ওয়াশিংটন কর্তৃক ঘোষিত নতুন ভিসা নীতির সাপেক্ষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে মোমেনের বিবৃতিটি বেশ আকর্ষণীয়। তিনি দাবি করেছেন যে, এই ভিসা নীতি শুধুমাত্র ধনী ব্যবসায়ী ও সরকারি চাকরিজীবীদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কংগ্রেসম্যানের চিঠিতে তথ্যের বড় ধরনের ঘাটতি ও অসামঞ্জস্য আছে বলে গণমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেছেন পরররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি আরও বলেছেন, এই ধরনের চিঠি অতীতেও এসেছে, আগামীতে আরও বড় আকারে আসতে পারে। জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এই ধরনের কার্যক্রম তত বাড়তে থাকবে।
পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন যে ‘’বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সীমা অতিক্রম এবং হস্তক্ষেপকারী রাষ্ট্রদূতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাপানের নতুন রাষ্ট্রদূত নির্বাচন কমিশন পরিদর্শন ও বিএনপির সঙ্গে দেখা করার পর তার এ বক্তব্য সামনে এসেছে। ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৪১(১) ,কূটনীতিকদের স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করে। এটি বাস্তবায়িত হলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষতি হতে পারে । অতএব, এটি খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ঢাকায় চলমান কূটনৈতিক দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকায় অসন্তুষ্ট, প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন যে তার শাসনের বিরুদ্ধে গোটা বিষয়টি পরিচালিত করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, সম্ভবত অজান্তেই, ক্ষমতায় থাকার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে লড়াই করছে। শুধু বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলের সঙ্গেই নয়, যে কোনো পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর আওয়ামী লীগ।