বাংলাদেশ নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের রশি টানাটানি
বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর মেরুকরণ প্রকাশ্যে চলে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পালটাপালটি মতামত দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্যে অশনিসংকেত। যুগান্তরের কাছে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা এ মতামত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে নিয়ে টানাটানি করা বিপজ্জনক। বাংলাদেশের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করা প্রয়োজন। শক্তিশালী দেশগুলোরও তাদের বৈরিতায় আমাদের টানা উচিত নয়।
অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রভৃতি ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত ঢাকাকে চাপ দিচ্ছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ২০ ঘণ্টা জার্নি করে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাবেন না। অন্য মহাদেশের প্রতি মনোযোগী হবেন। যারা স্যাংশন দেবে তাদের কাছ থেকে কিছু কেনা হবে না।
এদিকে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতাধর দেশটির বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার মন্তব্যকে সমর্থন জানিয়েছে চীন। চীন বলেছে, শেখ হাসিনার এমন মন্তব্য বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মনের কথা। এভাবে দুই বিশ্বশক্তির মত প্রকাশ্যে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানের প্রতি চীন সমর্থন জানিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতেও চীন সার্বিক সহায়তা করবে। সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও শক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ অন্য সব দেশের সঙ্গে কাজ করবে চীন। বুধবার বেইজিংয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন এসব কথা বলেন।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত শমশের মবিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ভূ-রাজনীতির চিত্র অনেক বছর পর নদীর স্রোতের মতো বাঁক নেয়। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। এখন তারা পরস্পরের বৈরী সম্পর্কে আবদ্ধ। তাদের এ বৈরিতার মধ্যে আজকে আমাদের টানা হচ্ছে। এটা আমাদের জন্যে কতটুকু মঙ্গলজনক তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। মূলত এটা হলো দুই হাতির মারামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ঘাসের মতো অবস্থা। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে আমরা কারও পক্ষে কিংবা বিপক্ষে অবস্থান নিতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের কিছু বলার থাকলে সেটা তারা সরাসরি বলুক। যুক্তরাষ্ট্রেরও চীনের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে সরাসরি বলুক। আমাদের নিয়ে টানাটানির কোনো প্রয়োজন নেই।
তিনি আরও বলেন, এখন বড় শক্তিগুলো যা করছে তা ভূ-রাজনীতির স্বার্থকে সামনে রেখে করছে। কিন্তু আমাদের স্বার্থে নয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা পরিপক্ব। তারা এ ব্যাপারে চুপ থাকার কৌশল নিয়েছে। আবার মৌনতা কখনও কখনও অসম্মতির লক্ষণ। সাবেক এ পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দেখতে চাই। পরাশক্তির লড়াইয়ের মাঝে আমাদের না পড়াটাই ভালো।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা একটা অশনিসংকেত। আমাদের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। যে বিষয়গুলোকে নিয়ে এটা হচ্ছে, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করার লক্ষ্যে আমাদের নিজেদেরকেই জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগী হওয়া দরকার।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে এ প্রতিযোগিতা চলতে থাকলে আমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব। বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর ভর করে চীনের মন্তব্যের কারণে আমাদের বেশ ক্ষতি হয়ে গেল। এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সন্দেহ করত যে, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। কিন্তু বেইজিংয়ের সর্বশেষ মন্তব্যের কারণে বিষয়টি এখন যুক্তরাষ্ট্রের বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হতে পারে। কাজেই এ বিপদ থেকে বাঁচতে হলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমাদের নিজেদের সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদেরই সমাধান করতে হবে।’ তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, এটা করতে ব্যর্থ হলে বিপদ বাড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন দ্বীপে ঘাঁটি করতে চায় বলে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের বক্তব্যকে ‘হুজুগে মন্তব্য’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন হুমায়ুন কবির। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ ভারত ও থাইল্যান্ড এ অঞ্চলেই রয়েছে। সেন্টমার্টিনে কোনো ঘাঁটি করার প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের নেই। ফলে এ ধরনের ইমোশনাল বক্তব্য না দেওয়াই ভালো।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকার খুশি নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দিলে অন্য দেশে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক থাকায় চীন এই সুযোগ নিয়েছে। চীনের জন্যে এটা একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চীন তাই বাংলাদেশের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছে। চীনের বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকার খুশি হয়েছে। কিন্তু বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ চীন আমেরিকার বিকল্প নয়। আমেরিকা যেসব কাজে আমাদের প্রয়োজন; সেটা চীন মেটাতে পারবে না। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা।
জানতে চাইলে চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য চীনের ভালো লেগেছে। তাই তারা সমর্থন দিয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এতে আবার অন্য একটা দেশের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তবে আমাদের সব দেশই বন্ধু। কারও কারও সঙ্গে কিছু সমস্যা আছে। ফলে সবার মতামত আমরা গ্রহণ করি। সবাই আমাদের পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে এমনভাবে কোনো পরামর্শ দেওয়া উচিত নয়, যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের সমস্যা আছে ঠিকই, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সব দেশের ক্ষেত্রে সমানভাবে পরামর্শ দেয় না। তাদের সহযোগী দেশগুলোর মানবাধিকার কিংবা গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যত শক্তিশালী দেশই হোক তাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করা উচিত। অর্থাৎ আমাদের দেশের সমস্যা বাইরের হস্তক্ষেপে সমাধান করা উচিত নয়। বাংলাদেশের জনগণের উচিত হবে দেশের সমস্যা নিজেরা সমাধান করা।