চট্টগ্রামে থামছে না কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এসব উঠতি অপরাধীরা দিনে দিনে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। তাদের অপরাধের ধরণও পাল্টে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিতে তারা নিত্যনতুন কৌশলে অবলম্বন করছে। এই ক্ষেত্রে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করছে। তাতে তাদের লাগাম টেনে ধরা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে।
এক সময় এই গ্যাং কালচার নগরীর অভিজাত এলাকায় সীমিত ছিল। এখন তা পাড়া-মহল্লা হয়ে গ্রামেও বিস্তৃত হয়েছে। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, পর্যটন স্পট, পাড়া-মহল্লায় কিশোর অপরাধীদের সীমাহীন দৌরাত্ম্যে জনমনে উদ্বেগ আতঙ্ক বেড়েই চলেছে। কোন কোন এলাকার সাধারণ মানুষ রীতিমত তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। র্যাব-পুলিশের অভিযানে মাঝে মধ্যে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য ধরা পড়লেও তাদের বেপরোয়া আচরণ থামছে না।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা থেকে শুরু করে ধর্ষণ, খুনোখুনিসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণেরা জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ব্যবসা ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। নানা অপরাধে জড়িয়ে কিশোররা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ক্যাডার, মাস্তান, বিভিন্ন ছাত্র ও যুব সংগঠনের নেতা, জন প্রতিনিধিরা এই কিশোরদের বিপদগামী করছেন। কোন কোন এলাকায় মহল্লা কমিটির কিছু নেতাও কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করছেন। তারা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে দলভারী করতে উঠতি তরুণ ও কিশোরদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। গেল মাসে নগরীর পাহাড়তলীতে কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে দুই কিশোরকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্যাংয়ের বড়ভাই এক শ্রমিক লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও কিশোর গ্যাং এবং বিভিন্ন গ্রæপের কিশোরদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিশোর গ্যাং কালচারে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও জড়িয়ে পড়ছে। স্কুল ও কলেজে পড়ুয়াদের সাথে বস্তির বাসিন্দা ও পথশিশুরাও সংঘবদ্ধ হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী এলাকা থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রস্তুতিকালে কিশোর গ্যংয়ের ছয়জনকে পাকড়াও করেছে র্যাব। তাদের কাছ থেকে স্টিলের চাকু, ধারালো ক্ষুর এবং চাইনিজ কুড়াল উদ্ধার করা হয়। র্যাব জানায়, তারা ওই এলাকার আতঙ্ক হিসাবে পরিচিত কালা বাচ্চু কিশোর গ্যাং গ্রæপের সদস্য। গতকাল গ্রæপ প্রধান ফরহাদ হোসেন ও পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতারের এ তথ্য জানায় র্যাব। ফরহাদের সহযোগীরা হলো- মো. হৃদয় মিয়া, মো. জুনায়েদ, মো. আনোয়ার হোসেন বাছা, মো. ইসমাইল হোসেন ও মো. নুরনবী নাঈম। তাদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।
র্যাব জানিয়েছে, বিভিন্ন ছত্রছায়ায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাÐে কিশোররা ব্যবহৃত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। তাদের লাগাম টানতে র্যাব নগরজুড়ে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখে। তারই ধারাবাহিকতায় দুষ্কৃতকারী কিশোর গ্যাং সদস্যরা দেশিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বায়েজিদ বোস্তামী থানাধীন আমিন কলোনি গলির পাশে নিভৃত স্থানে সমবেত হওয়ার সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে কালা বাচ্চু নামক কিশোর গ্যাং গ্রæপের প্রধানসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। সন্ত্রাসী ও অপরাধমূলক কর্মকাÐের জন্য সেখানে তারা একত্রিত হয়েছিল।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, কালা বাচ্চু কিশোর গ্যাং বায়েজিদ থানা এলাকায় রাস্তায় সংঘবদ্ধ হয়ে মারামারি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও এলাকায় প্রভাব বিস্তার করাসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। এছাড়াও এই গ্যাংয়ের সদস্যরা প্রকাশ্যে দিনে-দুপুরে এলাকায় সাধারণ কিশোরদের মারধর ও প্রাণনাশের হুমকি প্রদান, দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন এবং মাদক সেবন করে বলে জানা যায়। তারা বায়েজিদ এলাকাসহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘদিন যাবৎ ডাকাতি ও ছিনতাই করে আসছে। তারা সাধারণ মানুষসহ প্রাত্যহিক চলাচলরত বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজনকে দেশিয় অস্ত্রের মুখে ভীতি প্রদর্শন করে মূল্যবান জিনিসপত্র, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ফোন, নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার কথা অকপটে স্বীকার করে।
এর আগে গত ৮ জুন নগরীর কোতোয়ালী থানা এলাকা থেকে ‘টিন স্কোয়াড’ নামে কিশোর গ্যাং গ্রæপের পাঁচ সদস্যকে পাকড়াও করে র্যাব। তারা হলো- রাহি উদ্দিন রহমান নিশান, রবিউল হাসান, শাহিনুজ্জামান মাসুম, তাফহিম মো. মারূফ ও আবরার মুনতাসির আদনান। র্যাব জানায়, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের নামে একটি গ্রæপ খুলে সংঘবদ্ধ হয়ে নানা অপকর্ম করে আসছিল। তাদের ওই গ্রæপের পেইজে রাম দা হাতে নিয়ে কয়েকজনের ছবি আপলোড করা হয়। সেখানে তারা তাদের নানা অপকর্মের ছবি আপলোড করে। আর আগে নগরীর চকবাজার থেকে গ্রেফতার একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নামেও ওই রকম একটি পেইজ পাওয়া যায়। তারা সেখানে প্রতিপক্ষের উপর হামলা, অস্ত্রবাজি, এলাকায় মারামারি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার নানা ছবি ও ভিডিও আপলোড করতো।
আগে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর অপরাধীরা সংঘবদ্ধ হয়ে জটলা ও আড্ডা দিত। এসব আড্ডায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী হানা দেয়। তাই তারা এখন নিজেদের নামে ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রæপ খুলে। সেখানে যোগাযোগ করে নানা অপকর্ম করে। র্যাব ও পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও নৈতিক শিক্ষার অভাবে শিশু-কিশোরেরা বিপথে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে এককভাবে কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব হয়। এ জন্য পরিবার থেকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে অভিভাবক, শিক্ষকদেরও। সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া কিশোর গ্যাং কালচার দমন সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তারা।