চার সন্তানের মা মৌসুমী আক্তার পপি। স্বামীর বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরপারের নোয়ানগর গ্রামে। বাবার বাড়ি মাটিয়ান হাওরপারের রতনশ্রী গ্রামে। বোরো ধান কাটা শেষ হলে প্রতিবছর একবার ছেলে-মেয়ে নিয়ে নাইওর যান।
এ বছর হাওরে পানি না আসায় যেতে পারেননি।
ছেলে-মেয়েরা মামার বাড়ি যেতে প্রতিদিন বায়না ধরছে। আম-কাঁঠালের সময়ও শেষ হতে চলেছে। মৌসুমী বলেন, ‘মন তো মানে না।
নাও ছাড়া যাইতেও পারি না। সন্তানদের লুকিয়ে নিজেই কাঁদি।’
এই গৃহবধূর মনঃকষ্টের প্রতিফলন দেখা গেল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যে। সংস্থাটি জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার সুরমা নদীর পানি ৬.৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে।
গত বুধবার সুরমা নদীর পানি ছিল ৪.৭৫ সেন্টিমিটার ওপরে। এই মৌসুমে সুরমা নদীর বিপত্সীমা হলো ৭.৮০ সেন্টিমিটার। গত বছরের ১৪ জুন নদীর পানি ছিল ৭.৭১ সেন্টিমিটার এবং ১৫ জুন ৮.০৩ সেন্টিমিটার ওপরে।
এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল ১ আষাঢ়। বর্ষা শুরুর দিন।
গত মঙ্গলবার রাত থেকে অবশ্য হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওপারে মেঘালয়ের পাহাড়েও বৃষ্টি হয়েছে। গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে গতকাল সুনামগঞ্জের নদ-নদীতে পানি কিছুটা বেড়েছে। গত বুধবার সুনামগঞ্জে প্রায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টির খবর জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। গতকাল বৃষ্টি হয়েছে ১৯৪ মিলিমিটার। বুধবার সকালে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে তাহিরপুরের কেন্দুয়া নদীর ওপর আড়াআড়ি দেওয়া বাঁধ ভেঙে গেছে। তবে অন্য বছরের তুলনায় এই পানি অনেক কম।
এ বিষয়ে তাহিরপুর সদর বাজারের ভুসিমালের বৃহৎ ব্যবসায়ী সমীরণ কান্তি রায় লিটন বলেন, ‘মাছ হাওরের অর্থনীতিতে ধানের চেয়েও বেশি ভূমিকা রাখে। হাওরে পানি না থাকায় মাছ ধরতে পারছেন না জেলেরা। তাই বাজারে ৭০ শতাংশ কেনাবেচা কমে গেছে। হাওরের ধান গোলায় তোলার পর বাজারে কেনাবেচায় যে ধুম পড়ার কথা, তার সিকিভাগও নেই।’
বাদাঘাট বাজারের ধান-চালের ব্যবসায়ী পরাণ বৈদ্য জানান, বছরের এই সময় প্রতিদিন হাজার মণ ধান আসে মিলে। প্রতিদিন কয়েক শ বস্তা চাল বিক্রি হয়। কিন্তু হাওরে পানি না থাকায় ধান পরিবহন করা যাচ্ছে না। বাজারে ক্রেতাও আসছে না। চরম বিপাকে ব্যবসায়ীরা।
সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জুনাব আলী বলেন, ‘ত্রিশ বছর ধরে আমরা ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে পানির সঙ্গে ফসল রক্ষার লড়াই করি। কিন্তু এ বছর ছন্দঃপতন ঘটেছে। এ কারণে হাওরবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাপনে একটা অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। যাতায়াতে দুর্ভোগ ও খরচ বেড়েছে।’
বালিজুরী ইউনিয়নের বড়খলা গ্রামের জেলে গৌরাঙ্গ বর্মণ বলেন, ‘হাওরে পানি নেই, তাই মাছ ধরা বন্ধ। গত বছর যাদুকাটা নদীতে এ সময় আমরা কয়েকজন মিলে প্রতিদিন লাখ টাকার মাছ ধরেছি। কিন্তু এ বছর এক কেজি মাছও ধরা পড়েনি।’
সদর বাজারের ওয়ালটন শোরুমের ব্যবস্থাপক জিয়াউর রহমান বলেন, ‘হাওরে পানি আসার অপেক্ষায় বিয়ে বন্ধ। তা ছাড়া ক্রেতাদের এক শ টাকার মাল পরিবহনে এক হাজার টাকা লাগে। তাই শোরুমের ৭৫ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে।’
পর্যটক নৌকার ব্যবস্থাপক ইয়াসির আরাফাত অপু বলেন, ‘সবাই হাউস বোটে বসে বসে খাচ্ছে, আর পানির অপেক্ষা করছে। তাহিরপুর বাজারের কেনাকাটায়ও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।’
জামালগঞ্জ উপজেলার হালির হাওরপারের হরিণাকান্দি গ্রামের নববধূ সুবর্ণা আক্তার জানান, জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হলেও বাবার বাড়ি যেতে পারেননি। হালির হাওর আর শনির হাওর পাড়ি দিয়ে বাবার বাড়ি তাহিরপুর উপজেলা সদরে যেতে হবে। নৌকা ছাড়া যাতায়াত প্রায় অসম্ভব। তাই হাওরে পানি আসার অপেক্ষা করছেন তিনিও।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান খালেদা বেগম বলেন, হাওরের কুলবধূরা বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ছেলে-মেয়েরাও মামার বাড়ি যাবে আম-কাঁঠাল খেতে। সপ্তাহ-পনেরো দিন থেকে বধূরা নতুন শাড়ি আর ছেলে-মেয়েরা নতুন কাপড় নিয়ে নিজ বাড়ি ফিরবে। কিন্তু পানি না থাকায় এ বছর ছন্দঃপতন ঘটেছে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘আবহাওয়ার বৈশ্বিক পরিবর্তনের শিকার হাওরবাসী। বৃষ্টি কিছুটা শুরু হয়েছে। আশা করছি আষাঢ়ের মাঝামাঝিতেই ভাসা পানি হবে হাওরে।’
এই বিলম্বিত বর্ষার কারণ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের কমনওয়েলথ ইউনিভার্সািটি অব পেনসিলভানিয়ার ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান মতিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এল নিনোর ফলে ভারতের আসাম-গুজরাট অঞ্চলে পাঁচ থেকে আট শতাংশ বৃষ্টিপাত কম হবে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাত হবে ৯২ শতাংশ। ভারত, নেপাল ও চীন মিলিয়ে এ অববাহিকায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় এবার ভাটির দেশে (বাংলাদেশ) বন্যার আশঙ্কা নেই।’ এ রকম পরিস্থিতি ‘খুবই অস্বাভাবিক’ আখ্যা দিয়ে মতিন আরো বলেন, ফসল, জীববৈচিত্র্য, বাস্তুসংস্থান ও মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বর্ষা খুবই প্রয়োজনীয় ঋতু। স্বাভাবিক বর্ষা না হলে হাওরাঞ্চলে আগামী বছরের বোরো ফলনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। খরাও দেখা দিতে পারে।
ওয়াটারকিপারস বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বর্ষা বিলম্বিত হওয়ায় হাওরের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য নষ্ট হবে। যার অভিঘাতে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক ম. ইনামুল হক বলেন, হাওরের খাস জমি ইজারা দেওয়া ও প্রজনন মৌসুমের দুই মাস ভাসান পানিতে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে। বৈশাখ মাসে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো মাছের প্রজননের জন্য কেটে দিতে হবে। মাছের অভয়াশ্রমগুলো রক্ষা করতে হবে।
তবে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুদ্দোহা আশার কথা শোনালেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টা সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। এ সময় এই অঞ্চলের যাদুকাটা, কংস, ঝালুখালী, মনু, সোমেশ্বরী নদীতে পানি বাড়বে।
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/16/1290343