মশা নিয়ন্ত্রণে ঢিলেঢালা কর্মসূচির কারণেই ডেঙ্গু বাড়ছে। মে মাস থেকেই বেড়ে যাচ্ছে ডেঙ্গু। চলতি বছরে গতকাল বুধবারই সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর গত ১৫ দিনে তিনবার সংবাদ সম্মেলন করে ডেঙ্গু জীবাণুবাহিত এডিস মশার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। কিন্তু মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের বিশেষ কোনো কর্মসূচি ছিল না।
গতকাল বৃহস্পতিবার দেশে ২০১ জনের ডেঙ্গু আক্রান্তের পাশাপাশি একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার সকাল ৮টার পর থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২০১ জনের মধ্যে কেবল রাজধানী ঢাকাতেই আক্রান্ত হয়েছে ১৭৫ জন। বাকি ২৬ জন আক্রান্ত হয়েছে দেশের অন্যান্য জেলায়। গতকাল পর্যন্ত চলতি বছর মোট তিন হাজার ৮০২ জন আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে।
চলতি জুন মাসের গত ১৪ দিনে এ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কনট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা: মো: জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, জুনের ১৪ দিনে দেশে এক হাজার ৭৮০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সতর্ক করে দেয়ার পরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনে বিশেষভাবে কোনো কর্মসূচি নেয়নি। মশা নিধনে দায়িত্বপ্রাপ্ত এই দুই সংস্থা আগের মতোই গতানুগতিক পদ্ধতিতেই নিধন অভিযান চালাচ্ছে। চলতি জুন মাসে ডেঙ্গুতে ভুগে মৃত্যুর দিক থেকেও বিগত পাঁচ মাসের সম্মিলিত মৃত্যুর চেয়ে বেশি। জুন মাসের ১৪ দিনে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং জুন মাস ব্যতীত বাকি পাঁচ মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: আবুল বাসার মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন যে, এবারের ডেঙ্গুতে শক সিনড্রোম হয়ে মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
কেন মশা বেড়েছে- এ প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এবার বৃষ্টির ধরনটা ছিল একটু ব্যতিক্রম। মে’র শেষ দিকে দেশব্যাপী কিছুটা বৃষ্টি হওয়ার পর প্রায় দুই সপ্তাহ আর বৃষ্টি হয়নি বলে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে ডিম থেকে লার্ভা ফুটে পূর্ণ মশা হয়ে গেছে। মশা নির্মূলের জন্য লার্ভিসাইডিং ও ফগিং এই পদ্ধতিই ব্যবহার করতে হয়। ঢাকা শহরের কিছু কিছু এলাকায় নিয়মিত ফগিং করা হলেও অনেক এলাকায় ফগিং করা হয় না। এলাকাবাসী বলছেন, যেসব এলাকায় প্রভাবশালীরা থাকে এবং ফগিং করা হলে মিডিয়ায় প্রচার পাওয়া যায় সেসব এলাকায় বেশি ফগিং হয়ে থাকে। যেখানে কেউ দেখে না, প্রভাবশালীরাও থাকে না সেখানে ফগিং হয় না বলেই চলে। ফলে পূর্ণবয়স্ক এডিস মশারা উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে ডিম ছাড়তে পারছে এবং প্রচুর এডিসসহ অন্যান্য মশা বেড়ে গেছে।
অন্য দিকে লার্ভিসাইডিংয়ে চলে লুকোচুরি খেলা। পূর্ব রামপুরার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলছেন, লার্ভিসাইডিং যেভাবে করা উচিত সেভাবে করাও হয় না। চার পাশে স্থির হয়ে থাকা পানিতে যেন কোনো ডিম থাকলে তা নষ্ট হয়ে যায় অথবা ডিম ফুটে লার্ভা হয়ে গেলে সেগুলোও বাঁচতে না পারে সেরকম স্থানে লার্ভিসাইডিং করতে হয়। সিটি করপোরেশনের একশ্রেণীর কর্মী লার্ভিসাইডিংয়ে প্রচুর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি বলেন, তা ছাড়া লার্ভিসাইডিং করতে হয় খুব সকালে সূর্য উঠে পানি গরম হয়ে যাওয়ার আগেই। কারণ সুর্যের তাপে উপরের পানি গরম হয়ে গেলে লার্ভাগুলো পানির নিচে বা গভীরে চলে যায়। সে সময় উপরের পানিতে ওষুধ ছিটালে তা কাজ করে না। সিটি করপোরেশন সম্প্রতি ভোরে লার্ভিসাইডিং করার নির্দেশনা দিলেও কর্মীরা তা করে না বলে অভিযোগ আছে। তারা বেলা উঠলেই কাজে বের হয় এবং দৃশ্যমান কিছু স্থানে লার্ভিসাইডিং করে তাদের কাজ শেষ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অন্য দিকে নির্মাণাধীন ভবনে সিটি করপোরেশনের অভিযান দেখা যায় না বললেই চলে যেখানে দীর্ঘ সময় পরিষ্কার পানি জমে থাকে এবং অবাধে মশা বেড়ে ওঠে। ডেঙ্গু রোগবাহিত এডিস মশা যেহেতু পরিষ্কার ও স্থির পানিতে জন্মায় সে ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতাই প্রধান সমাধান। মূলত যেকোনো স্থানে বৃষ্টির জমা পানি বা টানা কয়েকদিন জমিয়ে রাখা পরিষ্কার পানি, ছাদে বা বারান্দায় গাছের টব, পাত্র কিংবা নারিকেলের খোল, টায়ারে জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে বংশ বৃদ্ধি করে এডিস মশা। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষকে সচেতন করতে মাইকিং, বিভিন্ন স্থানে লিফলেট, স্টিকার লাগানো, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দেয়া প্রয়োজন।