প্রথম আলোর একটি সমীক্ষামূলক প্রতিবেদনের শিরোনাম হলো, ‘ঢাকায় ৪০ মিনিটে একটি তালাক’। সারা দেশে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। গত বছর রাজধানীতে তালাক হয়েছে প্রতিদিন ৩৭টি করে। বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি। বিচ্ছেদ বাড়ছে ঢাকার বাইরেও।
বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছে। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে আত্মমর্যাদাবান নারীরা তালাকে খুঁজছেন মুক্তি। বিচ্ছেদের আবেদনের পর সমঝোতা হচ্ছে সামান্যই-৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবং জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবাহবিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। ইসলামি অনুশাসন থেকে জানা যায়, তালাক আল্লাহ অনুমোদন করেন না, তিনি এই কাজটিকে খুবই অপছন্দ করেন। এরকম একটি মুসলিম সমাজে মহামারির মতো তালাক বৃদ্ধি খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাহলে কি বলতে হবে আমরা ধর্মীয় অনুশাসন থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। এ কথা সত্য-আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক জীবনে ধর্মের হিতকর প্রভাবগুলো শিথিল হয়ে যাচ্ছে। হতে পারে আমাদের সমাজের ওপর পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে আমরা এর ভালোমন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। পাশ্চাত্য সমাজে পারিবারিক বন্ধন ক্রমেই শিথিল হয়ে গেছে। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন এমনভাবে পালটে গেছে যে, বৈবাহিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব এবং এর পবিত্রতা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। পাশ্চাত্যে বিগত কয়েক দশক থেকে পারিবারিক বন্ধন স্থিতিশীল করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। খ্রিষ্টান জগতের প্রধান ধর্মগুরু পোপ পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। সিনেমা-নাটকে আমরা পাশ্চাত্যের বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো দেখে থাকি। গির্জায় পাদরি বর ও কনেকে সামনে রেখে অত্যন্ত নিষ্পাপ ভঙ্গিতে উচ্চারণ করেন, আই প্রক্লেইম ইউ অ্যাজ ম্যান অ্যান্ড ওয়াইফ। পাদরি আরও কামনা করেন, এরা একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। এই বিশ্বস্ত থাকার ব্যাপারটি বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। যদি কোনো কারণে আস্থার ঘাটতি হয়, তখন সম্পর্কের পাটাতন নড়বড়ে হয়ে ওঠে। অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। মনোমালিন্য চরমে পৌঁছালে বিবাহবিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ মনোমালিন্যের কারণ হতে পারে শিক্ষা ও রুচির ক্ষেত্রে ব্যবধান, অর্থনৈতিক কারণ, একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা, পরকীয়া সম্পর্ক প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় একটি উক্তি, ‘মেনে নেওয়া ও মনে নেওয়া এক কথা নয়।’ শেষের কবিতার এই উক্তিটি বহুল আলোচিত। আমাদের সমাজ যখন এখনকার তুলনায় অনেক বেশি কুসংস্কারাপন্ন ছিল এবং নারীরা পতিকে দেবতাতুল্য মনে করত, তখন মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়েই সংসার টিকে থাকত। কিন্তু সময় বদলেছে। শিক্ষাদীক্ষায় মেয়েরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। নারীরা কর্মক্ষেত্রেও স্থান করে নিচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন ঘর-সংসার করার আর্থিক সংগতি বৃদ্ধি পেয়েছে, এর সঙ্গে হাত ধরে বৃদ্ধি পেয়েছে নারীদের আত্মমর্যাদাবোধ ও স্বাধীন চেতনা।
আজকাল দাম্পত্য জীবনে স্বাধীনতা একটি অনিবার্য চেতনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ চেতনার ফলে অপছন্দের এবং যা কিছু অবাঞ্ছিত, তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। এখন পতিদেবতা স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকের রক্ত-মাংসের মানুষে পরিণত হয়েছে। এই দেবতার পুজো করা এখন আর খুব স্বাভাবিক মনে হয় না। স্বামী-স্ত্রী যদি পরস্পরের মর্যাদা ও অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, তাহলে মানসিক সমঝোতা অর্জন করা খুব কঠিন হয় না। বিচ্ছেদের আবেদন নারীরা বেশি করছেন। এর একটি ব্যাখ্যা ইতোমধ্যেই করা হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের পর মুসলিম স্বামীদের স্ত্রীকে খোরপোষ ও দেনমোহর পরিশোধ করতে হয় বলেই পুরুষরা তুলনামূলকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে কালক্ষেপণ করে। তবে এ সময়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জীবনযাপন করে। বিবাহবিচ্ছেদের কারণে মারাত্মক সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিবাহিত দম্পতির সন্তান থাকলে তাদের ভরণপোষণ এবং লালনপালনের দায়িত্ব কার ওপর বর্তাবে, তা নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। যে কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুবয়সি সন্তানরা বেদনাদায়ক মানসিক কষ্টে পতিত হয়। এসব সন্তানকে ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তানরূপে গণ্য করা হয়। ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানসিক সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয় না। এমন সন্তানরা বখে যায়। কুসংসর্গে পড়ে এরা হয়ে যায় মাদকসেবী কিংবা কিশোর অপরাধী। ঢাকা শহরে যে কিশোর গ্যাংয়ের উদ্ভব ঘটেছে, এর পেছনে দাম্পত্য কলহ অথবা বিবাহবিচ্ছেদের প্রভাব কতটুকু, তা আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি।
আমাদের সমাজে বহুবিধ অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবক্ষয় রাষ্ট্রের ভিতটাকে নড়বড়ে করে ফেলেছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিবারের অবক্ষয় আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। একান্নবর্তী ও যূথবদ্ধ পারিবারিক কাঠামোর নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে রূপান্তর পারিবারিক জীবনে এমন সব অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, যা পরিবারের বন্ধনের প্রতি প্রচণ্ড হুমকিরূপে দাঁড়িয়ে গেছে। আধুনিক পরিবারগুলো শুধু নিউক্লিয়ার বা অণু পরিবারই নয়, অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক পিতা-মাতারা একের অধিক সন্তান নিতে চান না। যে পরিবারে একটি মাত্র সন্তান, যার আর কোনো ভাইবোন নেই, সে প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতায় ভোগে। তার যদি আরও দু-একটি ভাইবোন থাকত এবং একান্নবর্তী পরিবারের মতো থাকত চাচাতো ভাইবোন, তাহলে তাদেরকে নিঃসঙ্গতার শিকারে পতিত হতে হতো না। দুঃখজনক হলো, এ নিঃসঙ্গ ছেলেমেয়েগুলো একসময় মাদকাসক্ত কিংবা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে। সন্তানের বিপথগামিতাকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হয়ে ওঠে হলাহলময়।
ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৯৯৮টি, উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এই হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক, অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে ১টি করে। আর চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আবেদনের সংখ্যা ২ হাজার ৪৮৮। যদি আমরা জানতাম ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটিতে তালাকের সংখ্যায় তারতম্য কেন, যদি জানা যেত তালাকে অবতীর্ণ দম্পতিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত চিত্র, সামাজিক মর্যাদাগত অবস্থান, শ্রেণিগত অবস্থান প্রভৃতি; তাহলে তালাক নিয়ে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ হাজির করা সম্ভব হতো। ধারণা করা হয়, তালাক সমাজে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের সমস্যা। একেবারে দরিদ্র শ্রেণি এবং ধনাঢ্য শ্রেণি যেসব কারণে তালাক হয়, সেগুলো গায়ে মাখে না বলে তাদের ক্ষেত্রে তালাকের গল্প খুব একটা শোনা যায় না। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোকে সংহত করে রাখে, একইভাবে দারিদ্র্য দরিদ্র পরিবারগুলোকে সংহত করে। হতে পারে দরিদ্র পরিবারগুলো আইনকানুনের ধার ধারে না বলে তাদের মধ্যে তালাকের খতিয়ান নথিবদ্ধ হয় না। এ কারণে হয়তো তাদেরকে তালাকের আলোচনায় আমরা দৃশ্যমান হতে দেখি না। এসব অনুমানের কথা। সমস্যাটি বুঝতে হলে আমাদের অবশ্যই নিবিড় গবেষণার আশ্রয় নিতে হবে। প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেছেন, ‘বিবাহিত মেয়েদের সিংহভাগ স্বামীর পরিবারের শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার। লাগাতার নির্যাতনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।’
শিক্ষিত মেয়েরা স্বামীর পরিবারে অমর্যাদাকর আচরণে অপদস্ত হলে তা মেনে নিতে চায় না। অপমান ও অপদস্ততার মাত্রা যতই বাড়তে থাকে, তালাকের সম্ভাবনাও ততই তীব্র হয়ে ওঠে। বিবাহবিচ্ছেদ যে কয়েক বছর ধরে বাড়ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যেও দেখা যায়। বেশি বাড়ছে শিক্ষিত দম্পতিদের মধ্যে। বিবিএস-এর ২০২১ সালের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৫ বছর ধরে তালাকের হার ঊর্ধ্বমুখী। সবচেয়ে বেশি রাজশাহী বিভাগে, কম সিলেটে।
শিক্ষিত দম্পতিদের নিয়ে যে অনুমান করা হয়েছিল, তা বিবিএস-এর তথ্যে প্রমাণিত। তবে তালাকের হারে আঞ্চলিক পার্থক্য কেন, তা বোঝা দরকার। এই বিশ্লেষণও আমাদের তালাকের কারণ বুঝতে সাহায্য করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফাতেমা রেজিনা পারভিন বলেছেন, ‘সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগরজীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া প্রভৃতি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।’ নগরায়ণ, বিশ্বায়ন, বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন, শিক্ষার সঙ্গে মূল্যবোধের অসংগতি, অর্থনৈতিক কারণে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্ন জীবন, আকাশ সংস্কৃতি-সবকিছু মিলে তালাকের মতো একটি সামাজিক অবক্ষয় আমাদের জীবনকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ