সচরাচর দেখা যায়, একজন গ্রাহক নিজ মালিকানাধীন সম্পত্তি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ব্যাংক হতে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ গ্রহণ করে থাকেন। বন্ধককৃত সম্পত্তিকে ঋণ গ্রহীতার জামানত বলা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, ব্যাংকে গচ্ছিত স্থায়ী আমানতের বিপরীতেও ঋণ গ্রহণ করা হয়। ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত জামানতের কর্তৃত্ব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। একজন গ্রাহককে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামেও ঋণগ্রহণ করতে দেখা যায়। স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলতে গ্রাহকের মালিকানাধীন কলকারখানা ও বাণিজ্যিক উদ্দেশে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বুঝায়। ইতোপূর্বে বেনামী বা ভুয়া কিংবা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণের নজির না থাকলেও সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক প্রভাব ও জালিয়াতির মাধ্যমে বেনামী বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে একাধিক ঋণ গ্রহণের বিষয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেশবাসীর গোচরীভূত হয়েছে। বেনামী বা ভুয়া কিংবা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণের দায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং দায়িত্বশীল পদে আসীন কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না। এরূপ অনেক বেনামী বা ভুয়া কিংবা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে গৃহীত ঋণের সাথে ক্ষমতাসীন প্রভাবশালীরা সম্পৃক্ত থাকায় তা আলোচনায় এলেও ক্ষমতার প্রভাবের কারণে অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনানুগ ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ বা তৎপরতা প্রত্যক্ষ করা যায়নি; তবে ক্ষমতার পালাবদলে বেনামী বা ভুয়া কিংবা অস্তিত্ববিহীন ঋণের গূঢ় রহস্য যে উদঘাটিত হবে তা নিয়ে অনুসন্ধিৎসু অনেকের সংশয় নেই।
ব্যাংকের সাথে গ্রাহকের ঋণ বিষয়ক চুক্তির শর্ত অনুযায়ী যখন নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও ঋণ বা ঋণের কিস্তির অর্থ অনাদায়ী থাকে; তখন এ অনাদায়ী ঋণকে খেলাপি ঋণ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে খেলাপি ঋণ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রকট সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। খেলাপি ঋণে ব্যাংক খাত এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত বিপর্যস্ত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, ব্যাংক খাতের ঋণের ১২-১৩ শতাংশ খেলাপি বলা হলেও দেশের অর্থনীতিসংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে- এটি ৩০ শতাংশের কম নয়। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণে হ্রাস ঘটে এবং এ কারণে তারল্য সঙ্কট দেখা দেয়। আর তারল্য সঙ্কটে ব্যাংকের ঋণ দেয়ার সক্ষমতায় ছেদ পড়ে। দেশের স্বনামধন্য অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় উঠে এসেছে বর্তমান সরকার ১৪ বছর আগে যখন ক্ষমতাসীন হয় তখন দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমানে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের এ ব্যাপক বৃদ্ধির কারণসমূহের অন্যতম হচ্ছে রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যাংক পরিচালকদের প্রভাবে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান অনুসরণ না করে ঋণ বিতরণ।
খেলাপী ঋণের সাথে যে মহলটি জড়িত এর একটি অংশ অর্থ পাচারের সাথেও জড়িত এবং ধারণা করা হয় খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার করে খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা বিদেশে স্থায়ী নিবাস গড়ে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আনন্দ উল্লাসে দিনাতিপাত করছেন। অর্থ পাচারবিষয়ক দেশী ও আন্তর্জাতিক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে বিদেশে যায়। বিগত এক দশকে দেশ থেকে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ১১ লাখ হাজার কোটি টাকার অধিক।
সময়মতো কিস্তির টাকা বা ঋণ পরিশোধ না করায় অনেক ঋণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে বন্ধককৃত সম্পদের মূল্য গৃহীত ঋণকে ছাড়িয়ে যায়। ব্যাংকের একটি ঋণ যখন খেলাপি হয় তখন এটিকে মন্দ বা কু-ঋণও বলা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকের এমন অনেক মন্দ বা কু-ঋণ রয়েছে যা কখনো আদায় করা সম্ভব হবে না। আদায় অযোগ্য এসব ঋণের দুর্নাম আড়াল করতে ব্যাংকগুলো ব্যাপকভাবে অবলোপন করছে। ফলে প্রতি বছরই মন্দ ঋণ অবলোপনের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকের লাভ বা মুনাফা থেকে সাধারণ আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হচ্ছে মন্দ ঋণের বিপরীতে। এর পর ঋণ অবলোপন অর্থাৎ ব্যাংকের মূল হিসাব থেকে আলাদা করা হচ্ছে।
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বপ্রথম ২০০২ সালে মন্দ বা কু-ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করে। এ সময়ে যে ঋণ কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে মন্দ হিসেবে চিহ্নিত কেবল ওই সব ঋণ অবলোপন করার কথা বলা হয়। তবে এ ব্যাপারে শর্তজুড়ে দিয়ে বলা ছিল অবলোপনের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে। একই সাথে ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। এর কিছুকাল পর দেখা গেল নীতিমালাটি শিথিল করে উপরোল্লিখিত দু’টি শর্ত বাস্তবায়ন সাপেক্ষে দু’বছরের মন্দ ঋণও অবলোপন করার সুযোগ দেয়া হয়। এ ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিনিয়ত মুনাফা থেকে প্রভিশন রেখে মন্দ ঋণ অবলোপনের পথে এগিয়ে চলেছে। এতে করে যে ব্যাংকের লাভ বা মুনাফা অবলোপন খেয়ে ফেলে শেয়ারহোল্ডাররা বঞ্চিত হচ্ছে সেদিকে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কোনো ধরনের ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের অন্যতম কাজ। আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থের নির্ধারিত অংশ সংরক্ষণ করে অবশিষ্টাংশ ব্যাংক ঋণ হিসেবে বিতরণ বা বিনিয়োগ করে। গ্রাহকের আমানতের অর্থ হতে ঋণ বিতরণের কারণে এ ঋণ ব্যবস্থাপনাগত জটিলতায় অনাদায়ী হয়ে পড়লে ব্যাংক বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আর এ কারণে ঋণ বিতরণের পূর্বে ব্যাংকের যেসব সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তা হলো- আবেদনকারীদের মধ্যে কারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য, কোন কোন খাতে ঋণ দেয়া যেতে পারে, ঋণের মেয়াদকাল কত হবে, ঋণের বিপরীতে জামানতের ধরন ও প্রকৃতি কী হবে প্রভৃতি।
বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত পর্ষদের পরিচালকরা পরিশোধিত মূলধনের ৩০ ভাগ প্রদানপূর্বক পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়। এককভাবে একজন পরিচালককে পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম ৫ শতাংশ প্রদান করতে হয়। যে কোনো বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে পরিশোধিত মূলধনের অংশ হিসেবে যে পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত রাখেন তার তুলনায় ব্যাংকে আমানতকারীদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বহুগুণ অধিক। কিন্তু ব্যাংক পরিচালনায় আমানতকারীদের কোনো ভূমিকা নেই। আমানতকারীদের পক্ষ হতে তথাকথিত যে দু’জন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকদের হাতের পুতুল। বেসরকারি ব্যাংকের একজন পরিচালককে স্বনামে নিজ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে বারিত করা হলেও একশ্রেণির পরিচালক অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বেনামে বা ভুয়া নামে বা অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণগ্রহণ করে তা পরিশোধ না করে এটিকে খেলাপির পর্যায়ে ফেলে ব্যাংককে অযথা আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলছেন। তা ছাড়া এক ব্যাংকের পরিচালক অপর ব্যাংকের পরিচালকের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে অপর ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণ করেন এবং অপর ব্যাংকের পরিচালককে নিজ ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন। এরূপ ছলনা ও প্রতারণামূলক ঋণের অসংখ্য উদাহরণ দেশ ও জাতির সামনে রয়েছে কিন্তু এ ধরনের পরিচালকরা এক গোয়ালের গরুর ন্যায় সমস্বার্থে একে অপরের সহযোগী।
দেশে বড় ঋণ খেলাপি হিসেবে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম উচ্চারিত তাদের বিষয়ে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্ট সবাই অবগত। তাদের পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণের পরিমাণ যত অধিক হোক না কেন, এদের একটি অংশ রাষ্ট্রের ক্ষমতার সুবিধাভোগী হিসেবে নিজেদের ঋণ ইচ্ছামাফিক পুনঃতফসিল করে চলেছেন। তারা নিত্যনতুন ও অভিনব নিয়ম বানিয়ে পুঞ্জীভূত ঋণের একটি ক্ষুদ্রাংশ জমা দিয়ে প্রতিনিয়ত ঋণ পুনঃতফসিল করে পুনঃঋণ গ্রহণের দ্বার উন্মুক্ত রেখে পর্যায়ক্রমিকভাবে ঋণগ্রহণ করে চলেছেন। অথচ ৫-১০ হাজার টাকার ঋণ সুদে-আসলে পরিশোধ করতে না পারায় এ দেশের কৃষক শ্রমিক ও গ্রামের গৃহিণীদের পালিত হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, টিনের চালা ও ভিটেমাটি জবরদখল করে তাদের যে সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে; সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।
আমাদের দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত যেন সুষ্ঠুভাবে চলে তা দেখাশোনার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। খেলাপি, বেনামী বা ভুয়া বা অস্তিত্ববিহীন ঋণ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পদধারীসহ ভুক্তভোগী বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের যে আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে; তাতে দেশের সাধারণ জনগণের ব্যথিত হওয়া ছাড়া আর কি করার আছে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে যে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে এর প্রায় ৮০ শতাংশ মন্দ বা কু-ঋণ। এ মন্দ বা কু-ঋণের একটি বৃহদাংশ ইতোমধ্যে অবলোপন করা হয়েছে। এ অবলোপনের ফলে যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা হলেন ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারী ও সাধারণ শেয়ারহোল্ডার। ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের অদক্ষতা এবং দুর্নীতি অবজ্ঞা ও উপেক্ষাপূর্বক অন্যায়ভাবে আমানতকারীদের ন্যায্য মুনাফা এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান হতে বঞ্চিত করে সে অর্থ প্রভিশন হিসেবে রেখে অবলোপনের পথে অগ্রসর হয়ে তাদের আর্থিক ভিত দুর্বল নয় এটি দেখানোর প্রয়াস নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এ চাতুরী ও লুকোচুরি কার স্বার্থে? ব্যাংকের প্রত্যেক আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডার ব্যাংকের মালিক। আজ সাধারণ জনগণের অংশ নিরীহ আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের বঞ্চিত করে নামে-বেনামে যারা ঋণ গ্রহণপূর্বক খেলাপি করে দেশে-বিদেশে সুখের নীড় গড়ে তুলছেন তাদের সে আবাস যে চিরস্থায়ী হবে না; এ কথা ভেবে ব্যাংক ব্যবস্থার সার্বিক বিপর্যয়ের সাথে যারা জড়িত তারা যদি নিজেদের শোধরানোর ব্যাপারে সচেষ্ট হন, তাহলে তাদের পাপের ও অপরাধের হয়তো কিছুটা হলেও মার্জনা হবে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com