১০ জুন ২০২৩ শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আয়োজনে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। দীর্ঘ এক দশক পরে প্রকাশ্যে এমন সমাবেশে উপস্থিত জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়। দুই দফা আবেদনের পরে সমাবেশের মৌখিক অনুমতি পায় দলটি। সমাবেশটি শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হবার ব্যাপারে পুলিশী সহায়তাও ছিলো। এ কারণে জামায়াত কর্মীদের চোখে-মুখে অনেকটা নির্ভয়তা লক্ষ্য করা গেছে। তবে উপস্থিত নেতা-কর্মীদের ভেতরে বেশ ক্ষোভের ছাপ চোখে পড়ার মতো। অনেকেই বলেনÑ কোনো বাধা বিপত্তি আমরা মানবো না। দেশ আজ চরম হুমকির মুখে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে, বিদ্যুতের চরম ঘাটতি, সরকারের নানা দুর্নীতিতে আজ দেশ ছেয়ে গেছে। বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদেরকে অন্যায়ভাবে মামলা ও নানা হয়রানি করা বন্ধ করতে হবে। একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আর ঘরে বসে থাকা যায় না। সরকার আমাদের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। দিনের ভোট এখন রাতে নিয়ে সরকারে বসে জনগণের সাথে তামাশা করছে। এটা একটা চরম ধৃষ্টতা। সমাবেশস্থল জামায়াত নেতাÑ কর্মীরা নানা ধরনের শ্লোগানে মুখর করে তোলে। যেন উৎসবে পরিণত হয় তাদের সমাবেশটি।
সমাবেশের অনুমতি পায়-পায় না এমন দোলাচলের মধ্যে সংক্ষিপ্ত নোটিশে এবারের এই সমাবেশটি বেশ চোখে পড়ার মতো। ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ কারাবন্দী রাজনীতিক ও আলেমদের মুক্তি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার’ দাবি উঠে আসে নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায়।
দীর্ঘদিন পরে জামায়াতে ইসলামী প্রশাসনিক অনুমতি নিয়ে বিশাল সমাবেশ করার বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে জামায়াতের আঁতাতের গন্ধ খুঁজছেন অনেকেই। অন্যদিকে বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশ্য কোন সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য একই দিনে রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকায় ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘ বিএনপি-জামায়াতের দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন-জামায়াতকে মাঠে নামিয়েছে বিএনপি। (সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ১১জুন ২০২৩)
তবে জামায়াত আয়োজিত এই সমাবেশে অধিকাংশ নেতা তাদের বক্তব্যে বলেনÑ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি দায়িত্বশীল সংগঠন। আমরা যে দাবিতে আজ মাঠে নেমেছি; এ দাবি শুধু আমাদের একার নয়, এ দাবি এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের।
উল্লেখ্য, প্রতিবার নির্বাচন সামনে এলে নানাজন নানাভাবে জামায়াতকে নিয়ে বেশ বিশ্লেষণ করেন। জামায়াত কার সঙ্গ ছাড়লো, কার সঙ্গ নিলো এ নিয়ে মানুষের মাথা ব্যথার অন্ত থাকে না। এদেশের একধরনের বুদ্ধিজীবীদেরও ঘুম হারাম হয়ে যায়। কোন দিকে যাচ্ছে জামায়াত!
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সমাবেশ নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে সব কথা ছাপিয়ে এ কথা বলব-এ সমাবেশ দিয়ে জামায়াতকে পরিমাপ করা অতটা সহজ হবে না। আমার মনে হয়, জামায়াত এটি তাদের সাধারণ কোন কর্মসূচি হিসাবে গ্রহণ করেছে। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি বুঝে আরো নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করতে পারে জামায়াত। অবশ্য, জামায়াতের এই ঐতিহাসিক সমাবেশ নিয়ে দেশী-মিডিয়ায় এখন তুলকালাম ও তুমুল বিশ্লেষণ চলছে। তবে জামায়াতের এই সমাবেশ সামনের নির্বাচনে জামায়াতকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে বলে বিশেজ্ঞরা মনে করেন।
গোটা ১৫ বছর ধরে জামায়াত ইসলামীর লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মীকে নাশকতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধাসহ নানা মামলায় গ্রেফতার, রিমা-ের মতো শাস্তির মুখোমুখি করা এবং সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিলেও গত ১০ জুনের এই সমাবেশ প্রমাণ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা সুশৃঙ্খল ও শান্তিপ্রিয়। সময় গেলে তাদের এই চারিত্রিক মাধুর্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব জনমনে আরো বেশি প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা যায় এবং আরো একটি বিষয় বলা দরকার-রাজনৈতিক দলকে তার দলীয় কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেবার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একটি রাজনৈতিক দলকে তার গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে বারবার কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা, নানাভাবে হয়রানি ও হেনেস্তা করার মানে তাদেরকে আরো বেশি বিদ্রোহী করে তোলা। আমার মনে হয়, অন্যান্য দলের মতো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে তার কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেওয়া হোক। তাদের বন্ধ অফিসসমূহ খুলে দেওয়া, আটককৃত নেতা-কর্মীকে মুক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক সহাবস্থানের নিশ্চয়তাই এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ১১ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ল রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) আয়োজিত মিট দ্য রিপোর্টার্স অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেন- চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না জামায়াত দোষী।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী গত ১১ জুন রোববার দুপুরে সচিবালয়ে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) প্রকাশিত ‘ সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: জুলিও কুরি ও এশীয় শান্তি সম্মেলন’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নর জবাবে বলেনÑ জামায়াত এখনো যেহেতু নিষিদ্ধ হয় নাই, রাজনৈতিক দল হিসেবে আবেদন করেছে, সে জন্য তাদেরকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
একই দিনে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ অডিটোরিয়ামে হাইওয়ে পুলিশের ১৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেনÑ দেশের অনেক অনিবন্ধিত দলই বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করে। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাদের সভা-সমাবেশ ইনডোরে করতেই পারে। তারা ইনডোরে সমাবেশ করতে চেয়েছিলো, ডিএমপি কমিশনার সেটি যাচাই করে অনুমতি দিয়েছেন।
মাননীয় মন্ত্রীদের কথার মাধ্যমে বুঝা যায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ কোন দল নয়। তাদেরও রয়েছে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার। তাদের এ অধিকার ছিনিয়ে আনা ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামীতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা কোন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং কতদূর সফল হতে পারবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে এ কথা অনুমেয়-আগামী নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীই ফ্যাক্টর। দিনে দিনে তাদের গুরুত্বের কথা নানাভাবে উঠে আসছে এবং নানা মহলে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।