অর্থবছরের শেষ সময়ে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কমিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের চাহিদা বাড়িয়েছে সরকার। শুধু মে মাসেই এসব ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে ১৩ হাজার ১৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও একই মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে উল্টো ঋণ পরিশোধ করেছে ২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। মে মাস শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের নেয়া নিট ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। এটি এক অর্থবছরের হিসাবেও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সিংহভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোগান দিয়ে এলেও গত দুই মাস ধরে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকেও ঋণ নেয়া হচ্ছে।
ব্যাংকাররা বলছেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেতিবাচক ধারায় নেমেছে। বৈদেশিক ঋণ ছাড়েও গতি নেই। সরকারের রাজস্ব আদায়েও চলছে ধীরগতি। ফলে সরকার বাধ্য হয়েই ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে; এরইমধ্যে সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ানোয় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মে) পর্যন্ত ১১ মাসে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে (কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও তফসিলি ব্যাংক) থেকে ঋণ নিয়েছে ৯২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা সরকারের অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ৮২.৬৮ শতাংশ।
যদিও আগের অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে চলতি অর্থবছরে সরকার ঋণ নিয়েছে ২০ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা; যদিও আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে ৩০শে জুন সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭০ হাজার ১৮৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১১ মাসে নিট বেড়েছে ৯২ হাজার কোটির টাকার বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছিল মাত্র ৩২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছিল মাত্র ২ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিয়েছিল ৩০ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত অর্থবছরের পুরো সময়ে সরকারের নিট ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এটি তার আগের তিন অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। তবে এবার সেই রেকর্ডও ভাঙলো সরকার।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সরকারের যে উৎস থেকে রাজস্ব বাড়ানো উচিত, সেখান থেকে না বাড়ার কারণে ঘাটতি বাজেটের জন্য ব্যাংক ঋণ বাড়িয়েছে সরকার। তিনি বলেন, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের চেয়ে তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নিট ঋণ নিয়েছে প্রায় ৯২ হাজার ২৮৮ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে আগামী অর্থবছরেও সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে। নতুন অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৮৬ হাজার ৫৮০ কোটি। আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ৪৫ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা।
এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যদিও অর্থবছরের ১০ মাসে রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৬৭ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলেন, গত কয়েক মাসে ব্যাংকগুলোর আমানতের পরিমাণ বাড়ছে যার কারণে সরকার ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোও সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, এপ্রিল মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের আমানত দাঁড়িয়েছে ১৫.৪৮ লাখ কোটি টাকা। মার্চ মাসে এটি ছিল ১৫.২৩ লাখ কোটি টাকা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের আয় কম বলেই ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিতে হচ্ছে।