চট্টগ্রাম নগরে ২০০৭ সালের ১১ জুন ভয়াবহ পাহাড়ধসে মারা যান ১২৭ জন। এর মধ্যে লালখানবাজার ওয়ার্ডের মতিঝরনা এলাকায় মারা গিয়েছিল ১১ জন। পরের বছর আগস্টে একই এলাকায় মারা যায় আরও ১৪ জন। ২০১৩ সালে মারা যায় আরও দুজন। এর মধ্যে ছোটখাটো ধস লেগেই আছে। কিন্তু এরপরও মতিঝরনার পাহাড়ে বসতি বেড়েই চলেছে।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পরিবেশবাদীদের হিসাবে ১৫ বছর আগে মতিঝরনায় বসতি ছিল দুই শতাধিকের মতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে এক হাজারের বেশি। এই এলাকার পাহাড়ে ঝুঁকির বিষয়টি প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছেন স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল। আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, সামনে পাহাড়ধস হলে এসব এলাকায় অতীতের চেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটবে।
নদীদূষণ হলে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যাবে। কিন্তু পাহাড় ধ্বংস করা হলে কেউ বানাতে পারবে না। কিন্তু চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে পাহাড় কাটা ও বসতি দুটোই বাড়ছে।
গত রোববার সরেজমিন মতিঝরনার টাংকির পাহাড়ে দেখা গেছে, পাহাড়ের খাঁজে ও পাদদেশে গড়ে উঠেছে কাঁচা-পাকা অসংখ্য স্থাপনা। এসব বসতিতে রয়েছে বিদ্যুৎ–সংযোগও। এর মধ্যে পাহাড়ের উত্তর দিকের খাঁজে নির্মিত হচ্ছে একটি নতুন পাকা ঘর।
মতিঝরনার পাশাপাশি ২০০৭ সালের পর দেড় দশকে চট্টগ্রাম নগরের ৫টি ওয়ার্ডের ২৬টি পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েছে অন্তত ১০ গুণ। চট্টগ্রাম পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির হিসাবে, বর্তমানে অবৈধ বসতির সংখ্যা ৬ হাজার ১৭৫। অথচ ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১টি পাহাড়ে অবৈধ বসতি ছিল ৬৬৬টি।
উল্লেখযোগ্য ছিল পাহাড় কাটা বন্ধ করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটি কেবল বর্ষা এলেই সভা করে দায় সারে।পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, প্রতিবছর বর্ষায় অনুষ্ঠিত সভায় একই সিদ্ধান্ত হয়। কিছু বসতি উচ্ছেদ চলে। পরে সব আগের অবস্থায় চলে যায়।
সুপারিশ কাগজেই, বর্ষা এলে তোড়জোড়
২০০৭ সালে গঠিত পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্ব ছিল বিশেষজ্ঞ কমিটির দেওয়া ৩৬ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পাহাড় কাটা বন্ধ করে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ করা। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটি কেবল বর্ষা এলেই সভা করে দায় সারে। সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল কমিটির ২৬তম সভায় অবৈধ বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে উচ্ছেদ ও পাহাড় কাটা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
পরিবেশবাদীদের অভিযোগ, প্রতিবছর বর্ষায় অনুষ্ঠিত সভায় একই সিদ্ধান্ত হয়। কিছু বসতি উচ্ছেদ চলে। পরে সব আগের অবস্থায় চলে যায়। মূলত রাজনৈতিক প্রভাবেই পাহাড় কেটে বসতি গড়ে উঠছে।
এদিকে চট্টগ্রামের ঘটনার এক দশক পরে এসে ২০১৭ সালের ১৩ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় পাহাড়ধসে ১৬৮ জনের মৃত্যু হয়। রাঙামাটি শহরে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পাঁচটি এলাকা—রূপনগর, নতুনপাড়া, শিমুলতলী, পশ্চিম মুসলিমপাড়া ও ভেদভেদী। সব কটি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতি বেড়েছে। জেলা প্রশাসন কিংবা পৌরসভায় হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে ২০১৭ সালের চেয়ে এ সংখ্যা পাঁচ শতাধিক বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা।
পাহাড় কাটা বন্ধ করতে না পারা ও বসতি বেড়ে যাওয়ার দায় জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নিতে হবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীদূষণ হলে দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া যাবে। কিন্তু পাহাড় ধ্বংস করা হলে কেউ বানাতে পারবে না। কিন্তু চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনক হারে পাহাড় কাটা ও বসতি দুটোই বাড়ছে।