গত ১০ জুন ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ জামায়াতের উদ্যোগে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশ নিয়ে দেশে বিদেশে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। প্রায় ১০ বছর পর প্রকাশ্যে জামায়াতের এই সমাবেশ অনুষ্ঠানকে কেউ সরকারের সাথে আঁতাত হিসেবে দেখছেন, কেউ কেউ মনে করছেন যে, একটি আদর্শবাদী দল হিসেবে বিনা বাধায় প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করতে না পারলেও তারা কখনো নিষ্ক্রিয় ছিল না। অত্যাচার, অবিচার ও নিষ্ঠুরতার পানি সেচ তাদের নতুন বলে বলীয়ান করেছে এবং আল্লাহর উপর বিশ^াস তাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে। আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধী কিছু লোক মনে করছেন যে, জামায়াত সরকারের সাথে আঁতাত করেছে এবং সমাবেশ অনুষ্ঠানের সরকারী অনুমতিকে তারা জঙ্গীবাদের পুনরুত্থানের আভাস বলে মনে করছেন। সরকারের চারজন মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতার মতে তারা সংবিধান অনুযায়ী জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছেন। কিছু কিছু সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদের মধ্যে অসহনীয় চুলকানির ভাবও পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ আমার আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়।
জামায়াত নেতারা এই সমাবেশে বক্তৃতাকালে কয়েকটি দাবির উল্লেখ করেছেন। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য হ্রাস, জামায়াত আমীর ডা. শফিকুর রহমান, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আনম শামসুল ইসলাম, আজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান প্রমুখসহ ওলামায়ে কেরামের মুক্তি, জামায়াত অফিসসমূহ খুলে দেয়া প্রভৃতি। এই দাবিগুলোর কোনোটিই অযৌক্তিক নয়। তাদের ধারণা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যদি কেয়ারটেকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি সরকার মেনে নেন এবং পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন করে অবিলম্বে পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই অন্য দাবিগুলো পূরণ সহজতর হয়। দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাও তাই।
কেয়ারটেকার সরকারের ইস্যুটি আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে আমার মনে হয়। এই আওয়ামী লীগ ও তার নেত্রী শেখ হাসিনা, জামায়াতের কেয়ারটেকার ফর্মুলাকে নিজেদের উদ্ভাবন বলে ঘোষণা করে জামায়াতকে সাথে নিয়ে আন্দোলন করেছেন। এজন্য ১৭৩ দিন হরতালও করা হয়েছিল। তারা আজীবন কেয়ারটেকার ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় গিয়ে তারা কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। এখন পুনরায় কেয়ারটেকার ব্যবস্থায় ফিরে আসা আসলে কি সহজ? এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এখানে আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয়ের কয়েকটি ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করতে চাই। শেখ হাসিনার ভয়ের ক্ষেত্রসমূহ :
১। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে পল্টনে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা বা খুনের মামলার অন্যতম আসামী হিসেবে তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা হয়েছিল। এই নরহত্যাকে কেন্দ্র করে তখন সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সরকার প্রেস নোট জারি করে তাকে বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে তার নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলের ধ্বংসাত্মক আন্দোলন হরতাল, অবরোধ, গার্মেন্টস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, বন্দরে অচলাবস্থার সৃষ্টি ও লগি-বৈঠার নৈরাজ্য দেশে তৎকালীন জরুরি অবস্থা জারির জন্য দায়ী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফর থেকে তার দেশে ফেরার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে ভারত ও মার্কিন সুপারিশে অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন দেখিয়ে ওয়ারেন্ট ফিরিয়ে নেয়া এবং প্রেস নোট প্রত্যাহারের ঘটনাও ঘটেছিল। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ব্যাপারে তার কথিত বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট গোটা বিষয়টি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে মার্কিন অনুকম্পা ও দি ইকনোমিস্ট সাময়িকীর তথ্যানুযায়ী বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকার বদৌলতে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে তার ও তার দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এখন যদি তিনি ক্ষমতা হারান তাহলে খুন ও লুটতরাজের উপরোক্ত অভিযোগগুলো আবার জিন্দা হয়ে তাকে ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। এই ভয় ও আতঙ্ক তার রাতের ঘুম হরাম করে দিয়েছে।
২। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০০৭ সালের জুলাই মাসে সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে যে সরকারকে তিনি তার আন্দোলনের ফসল বলে অভিহিত করেছেন) শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার গ্রেফতারের পূর্বেই এক-দেড় মাসের ঘটনাবলী ছিল খুবই চমকপ্রদ। তার দলের নেতারা; এমনকি যিনি তার সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন সেই আবদুল জলিলসহ তার ঘনিষ্ঠজনরা সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার কাছে যে তথ্য দিয়েছিলেন তা ছিল অত্যন্ত মারাত্মক। এই তথ্যগুলো ঐ সময় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসমূহে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল এবং এখনো ইউটিউব ও গুগলে পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়কারী জনাব আবদুল জলিল, ওবায়দুল কাদের এবং শেখ সেলিম গোয়েন্দা সংস্থার কাছে দেয়া তাদের জবানবন্দিতে এক ও অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্ব ও সিদ্ধান্তে দল পরিচালিত হয়। বাহ্যতঃ দলটির গণতান্ত্রিক লেবাশ থাকলেও কার্যতঃ এই দলে গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। তাদের ভাষা অনুযায়ী তার প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেশ এবং জাতির স্বার্থের পরিপন্থী। তার এবং দলের অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিমের দেয়া তথ্যানুযায়ী সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় তারা শেরাটন হোটেলের পাশে বিআরটিসির দোতলা বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ১১ জন নিরীহ লোককে হত্যা করেছিলেন। এর নেপথ্যে ছিলেন যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাধারণ সম্পাদক মীর্জা আজম। তারা যুবলীগ অফিসে বৈঠক করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং পার্টি সভানেত্রী নাশকতার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। জনাব জলিল ও শেখ সেলিম উভয়েই তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন যে, তাদের দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এই সম্পদের বেশির ভাগ তিনি বিদেশে তার ছেলেমেয়ে এবং বোনের নামে রেখেছেন। আমেরিকায় ছেলের নামে ব্যাংক ব্যালেন্স ছাড়াও বিপুল সম্পদ আছে। মেয়ে এবং বোনের নামে বাড়ি গাড়ি ছাড়াও বিভিন্ন সম্পদ এবং ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। জনাব জলিলের জবানবন্দী অনুযায়ী তার দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে উৎকোচের টাকা নিতেন এবং তার মত করে রাখতেন। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী তাকে বিদেশের ব্যাংক থেকে উৎকোচ দিয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী চেকে নিলে সমস্যা হতে পারে এজন তিনি ঘুষের টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাগ, বস্তা বা স্যুটকেসে করে নিতেন। তিনি আরো বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গণভবনে টাকা নিতেন পরে সুধাসদনে। জলিলের মতে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী শাসনামলে একেকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়ার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিন কোটি টাকা উৎকোচ দিতে হতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান মঞ্জুরে ইলাহী এবং ডা. ইকবালকেও তিন কোটি টাকা করে ঘুষ দিয়ে ব্যাংক খোলার অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তিনি আরো জানিয়েছিলেন যে, বসুন্ধরা গ্রুপ শেখ হাসিনাকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা দিত। এছাড়াও তারা তাকে বসুন্ধরা সিটিতে এক বিঘার একটি প্লট উপহার দিয়েছে যা তিনি তার বোনের নামে করিয়ে নিয়েছেন। সেনাসমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের আমলে আদালতে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, উৎকোচ গ্রহণ, আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছিল। এই সব মামলার অনুকূলে চেক বই-এর কাউন্টার কয়েলসহ প্রামাণ্য দলিলও দাখিল করা হয়েছিল। এর মধ্যে অন্তত: চারটি মামলার সাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ ও শুনানি শেষে বিচারিক রায় দেয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ ও চাঁদাবাজির জন্য আওয়ামী লীগের আরো প্রায় ১০ সহ¯্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং মার্কিন অনুকম্পায় ২০০৮ সালের ১১ জুন শেখ হাসিনা মুক্তি পান, এই দিবসটি আওয়ামী লীগ তার জেলমুক্তি দিবস হিসেবে এখন প্রতিবছর পালন করে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে ল-নের বিখ্যাত ‘দি ইকনমিষ্ট’ পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী তিনি বস্তা বস্তা ভারতীয় টাকার জোরে জয়লাভ করে ক্ষমতাসীন হন এবং সংসদে সিদ্ধান্ত নিয়ে তার এবং দলীয় নেতাদের দুর্নীতির মামলা তুলে নেন। তখন বেগম জিয়াসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাসমূহ প্রত্যাহারের প্রশ্ন উঠেছিল। আওয়ামী নেতৃবৃন্দ তখন বলেছিলেন যে, বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারের জন্য তারা ক্ষমতায় আসেননি। তাদের মামলাগুলো রেখে দিয়ে তাদের এই আমলে ব্যবহার করা হয়েছে। বেগম জিয়া, জিয়া অফানেজ ট্রাস্টের যে মামলায় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কারাদ- পেয়েছেন এই কারাদ- তার প্রাপ্য ছিল না। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে এটা মামলার উপযোগী কোন ঘটনাই ছিল না। যদি এখন কেয়ারটেকার সরকারের দাবি মেনে নেয়া হয় তাহলে নির্বাচন পরিচালনায় তার কোনও হাতই থাকবে না। এতে আগামী নির্বাচনে তার পুনরায় ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নস্যাত হয়ে যাবে।
(৩) কেয়ারটেকার সরকারের আরেকটি স্মৃতিও শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়ে গিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ছিল তাদের নিজেদের পছন্দের। যাকে এবং যাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল তারা সকলেই তাদের পছন্দের লোক ছিলেন। সংবিধানে বর্ণিত নিয়মানুযায়ী বিচারপতি লতিফুর রহমান কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তার উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে দায়িত্ব গ্রহণ করেই তিনি সচিবালয়সহ মাঠ প্রশাসনে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও অনুরূপ পরিবর্তন আনা হয়। সারাদেশের পরিবেশ পাল্টে যায়। ফলে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে যায় এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ নেত্রী এই অবস্থায় প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
(৪) ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির ধুয়া তুলে বাংলাদেশের ঐক্য, সংহতি এবং সার্বভৌমত্বের মূলে শুধু কুঠারাঘাতই করেননি দুনিয়ার নিকৃষ্টতম স্বৈরতন্ত্রও দেশে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা দেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, সিভিল প্রশাসন, মিলিটারী ও বর্ডার ফোর্সসহ সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার অভিযোগ করেছেন যে, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণ করে ফেব্রুয়ারি মাসেই তারা পিলখানায় আর্মি ও বিডিআর অফিসারদের উপর নির্মমভাবে হত্যাকা- চালায়। এই হত্যাকা- ঠেকানোর প্রচুর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঠেকানো হয়নি। সেনাবাহিনীকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা বৈঠকের পর বৈঠক করে এই ষড়যন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করেন। প্রধানমন্ত্রী অপরাধীদের নিয়ে তার দফতরে মিটিং করেছেন কিন্তু এই মিটিং-এর কোনও ভিডিও চিত্র গ্রহণ করতে দেয়া হয়নি, আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিলখানায় এক ঘন্টা যাবৎ সময় কাটিয়েছেন কিন্তু হতভাগ্য আর্মি ও বিডিআর কর্মকর্তাদের বাঁচানোর কোনও পদক্ষেপ নেননি। পিলখানা এলাকার এমপি পিলখানার দেড় কিলোমিটার ব্যানারের মধ্যে বসবাসকারী সমস্ত লোকজনদের (পরিবারসহ) সরে যাবার নির্দেশ দেন এবং এইভাবে অপরাধীদের পালিয়ে যাবার করিডোর তৈরি করে দেয়া হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল বৃটিশ শাসনামলের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের চেয়েও নির্মম। ৫৭ জন চৌকস, দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তা এতে নিহত হন। এতো সেনাকর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসেও নিহত হননি। সেনা অফিসারদের উপর এই আঘাত আমাদের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাতের শামিল ছিল। ২০১৪ সালে তারা নির্বাচন হতে দেননি, বিনা ভোটের পার্লামেন্ট গঠন করে ক্ষমতা দখল করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল আরো প্রহসনমূলক। এই সময় দিনের ভোট রাতে করে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হন। প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এজন্য ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়। ঐ সময়ে কর্মরত ও বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক কর্মকর্তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এর পুরস্কার হিসেবে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ ও এজেন্সির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রচুর অর্থ উপঢৌকন হিসেবেও দেয়া হয়েছিল। নির্বাচন (?) শেষে তাদের প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা পত্র-পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছে। গত ১৪ বছরে তারা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের উপর অভাবিত পূর্ণ নিপীড়ন চালিয়েছেন। এই সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে এমন কোন নিপীড়ন নেই যা বিরোধী দলগুলোর উপর করা হয়নি। তাদেরই নিযুক্ত, পদচ্যুত ও দেশ থেকে বহিষ্কৃত প্রধান বিচারপতি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, কিভাবে দলটির সরকার জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় আদায় করে নিয়েছেন, কিভাবে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে কসাই কাদের এবং নির্দোষ মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীকে দেলু রাজাকার বানিয়ে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এই ইতিহাস অনেক বড় এবং পত্রিকার একটি কলামে বর্ণনা করার মতো নয়। আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছরে বিএনপি-জামায়াতের ৩৩ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
এসব নেতা-কর্মীর পক্ষে নিজ বাড়ি বা এলাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে এসব মামলায় অভিযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে পুলিশকে পয়সা দিতে হয়েছে। জামিনের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে এবং প্রায় প্রতি মাসে কোর্টে হাজিরা বাবত তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থের অপচয় হচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেত্রী এমন কোনও নির্বাচনী ব্যবস্থায় সায় দিতে পারেন না যাতে তাদের ক্ষমতায় ফেরার নিশ্চয়তা নেই। আমি যখন এই নিবন্ধটি লিখছিলাম তখনি খবর পেলাম যে মেয়র নির্বাচনের প্রার্থী চরমোনাই-এর পীরের উপর হামলা হয়েছে এবং তার মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা কিসের লক্ষণ?
আনন্দবাজার পত্রিকা গত পরশু একটি খবর ছাপিয়েছে। খবরটি আওয়ামী লীগের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। এতে বলা হয়েছে যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন সফরে যাচ্ছেন এবং তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের উপর আরোপিত ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের সাথে আলোচনা করবেন এবং এর ফলে বাংলাদেশ জঙ্গী তৎপরতা বৃদ্ধির আশংকার কথা তাকে বলবেন।
ভারতের জন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকার যা করেছেন তা কেউ কল্পনা করতে পারেন না। শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন যে ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। ভারতের তরফ থেকে এর প্রতিদান তো তিনি আশা করতেই পারেন। জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ না হয় তা হলে কেয়ারটোর সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ আসবে বলে আমি মনে করি না।