দেশের রাজনীতিতে আবারও প্রধান্যে এসেছে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী। এ সংক্রান্ত আলোচনায় একদিকে পঞ্চদশ সংশোধনীর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করা হচ্ছে, অন্যদিকে দাবি জানানো হচ্ছে ওই সংশোধনী বাতিল করার জন্য।
কেন পঞ্চদশ সংশোধনীকেন্দ্রিক এত তৎপরতরা সে কথা জানার জন্য কিছুটা পেছনে যেতে হবে। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, দেশপ্রেমিক বিভিন্ন দল ও মহলের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমরাও এক সময় সরকারকে বলেছিলাম, ‘ভাবিয়া করিও কাজ’। বলতে হয়েছিল সংবিধান নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়ি ও রাজনৈতিক অর্থে প্রতারণার পরিপ্রেক্ষিতে। কারণ, আদালতের ‘রায়ের আলোকে’ সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলার জন্য ক্ষমতাসীনরা সে সময় এমনভাবেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন যা দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাদের হাতে আর কোনো কাজ নেই! ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়ানোর, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়ার এবং বিনামূল্যে সার দেয়ার মতো অঙ্গিকারগুলোর কথা ওই দিনগুলোতে তারা ভুলেও স্মরণ করেননি। কেউ স্মরণ করিয়ে দিতে গেলে পুলিশকে দিয়ে লাঠিপেটা করিয়েছেন। একযোগে শুরু হয়েছিল মোবাইল কোর্টের নামে ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানার কর্মকান্ডও।
আজকের নিবন্ধ এভাবে শুরু করার প্রধান কারণ হচ্ছে, ২০১৫ সালের ২০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন তারা সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটির ৫১ দফা সুপারিশের ভিত্তিতে। ৫১ দফায় সংবিধানের কোন কোন স্থানে সংশোধনী আনার সুপারিশ করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বিশেষ কিছু তথ্যের উল্লেখ করা দরকার।
এরকম একটি তথ্য হলো, সে বছরের ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে সরকারের গোপন যোগসাজশ ও সমঝোতা নিয়ে নতুন করে কথা উঠেছিল। কারণ, সংসদীয় কমিটির পরামর্শে ১০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিল ঠিক সেভাবেই ১০ মে রায় দিয়েছিল বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। অর্থাৎ আগে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়েছিল এবং তারও তিন মাস পর ব্যবস্থাটিকে বাতিল ঘোষণা করেছিল পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
অন্য একটি তথ্য হলো, একই বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বে হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পুরোটাও বাতিল ঘোষণা করেছিল। আপিল বিভাগও রায়টিকে বহাল রেখেছিল। এর পরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। অথচ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে তখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে শুনানিই শুরু হয়নি।
শুনানি শুরু হয়েছিল ১ মার্চ থেকে, ‘সংক্ষিপ্ত আদেশের’ আকারে যার রায় ঘোষিত হয়েছিল ১০ মে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছিল ১০ ফেব্রুয়ারি। এর একটি মাত্র ব্যাখ্যাই হতে পারেÑ প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করেছিলেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একে ‘গুরুতর বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ না করে পারেননি। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছিল, সরকার আদালতের রায়ের আলোকে ব্যবস্থা নিয়েছে, নাকি আদালতই সরকারের ইচ্ছার আলোকে রায় ঘোষণা করেছিল?
এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়েছিল সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিশেষ সংসদীয় কমিটি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে রাখা দূরে থাকুক, দল দুটির বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। অখ্যাত ও প্রত্যাখ্যাত এমন কিছু দল ও সংগঠনকে নিয়ে মিস্টার সেনগুপ্তর কমিটি আসর মাতিয়েছিল, যারা শুধু জনবিচ্ছন্ন নয়, যাদের কারো কারো বিরুদ্ধে দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে নেয়ার লক্ষ্যে অপতৎপরতা চালানোর শক্তিশালী অভিযোগও ছিল। এজন্য এবং বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় সংসদীয় বিশেষ কমিটিকে নিয়ে প্রথম থেকেই ছিল জোর বিতর্ক। অর্থাৎ ওই কমিটি বিতর্কিত হয়ে এসেছে।
ওদিকে কমিটি যে ৫১ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল তার মধ্যেও জনগণের আশা-আকাংক্ষার প্রতিফলন তো ঘটেইনি, উল্টো বিপরীত অনেক কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই ৫১ দফা সুপারিশ নিয়ে কমিটি সে বছরের ৩০ মে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিল। উল্লেখ্য, সুপারিশগুলো নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও মতপার্থক্যের প্রকাশ ঘটেছিল। যেমন কমিটির দুই সদস্য রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের প্রশ্নে কঠিন আপত্তি জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংসদে বলেছিলেন, কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়টি ‘পরিপূর্ণ’ নয় এবং এর মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ রয়েছে। পাশাপাশি প্রকাশিত খবরে জানা গিয়েছিল, সংসদীয় বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকেও নাকি রায়টির ব্যাখ্যা ও পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়া সাপেক্ষে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাবটিকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেদের কারণেই কমিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ করতে বাধ্য হয়েছিল।
অন্যদিকে সে বছরের ৫ এবং ১২ ও ১৩ জুন পালিত হরতালের মধ্য দিয়ে জনগণ কিন্তু সংবিধানের ব্যাপারে নিজেদের আকাংক্ষা ও অভিমতের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটিয়েছিল। প্রমাণিত হওয়ার অপেক্ষা থাকেনি যে, আদালতের দোহাই দিয়ে সংবিধান সংশোধনের যে চেষ্টা সরকার করছিল জনগণ সে চেষ্টাকে সমর্থন করে না। ক্ষমতাসীনরা যে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই আদালতের রায়কে অজুহাত বানিয়েছিলেন সে কথাও বুঝতে পেরেছিল জনগণ। প্রসঙ্গক্রমে আলোচনার প্রাধান্যে এসেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। কারণ, চাকরিতে থাকাকালে এমন কিছু রায় তিনি দিয়েছিলেন যেগুলো দেশের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করেছে। বিদায়ের প্রাক্কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া রায়ের মাধ্যমেও রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাতকেই অনিবার্য করে গেছেন তিনি।
এদিকে সংবিধানকে লন্ডভন্ড করে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বিতর্কিত ও জনগণের পর্যায়ে প্রত্যাখ্যাত যে কয়েকটি রায় জাতির ঘাড়ে চাপিয়ে রেখে গেছেন সেগুলোর ‘আলোকেই’ সরকার সংবিধান সংশাধন করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে ৫১ দফা সুপারিশ তৈরি করেছিল ক্ষমতাসীনদের সংসদীয় বিশেষ কমিটি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেসব সুপারিশই গ্রহণ করা হয়েছিল। সেগুলোকেই অনির্বাচিত আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ জাতীয় সংসদে বিল আকারে উত্থাপন করেছিলেন। আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতেও সে ৫১ দফারই যাচাই-বাছাই করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, সেখানে অনুমোদন দেয়া হলে বিলটি আবারও সংসদে উত্থাপিত হবে। তারপর এসেছিল ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ প্রসঙ্গ।
বলা হয়েছিল, ৫১ দফায় তথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ রাখা হলেও ব্র্যাকেটে দুটি অনুবাদ দেয়া হয়েছে যার দ্বিতীয়টি অশুদ্ধÑ ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’। কারণ, রাহমান বা রাহীমের অর্থ ‘করুণাময় সৃষ্টিকর্তা’ নয়। তাছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাগুলো বাদ দেয়া হয়েছিল। ৫১ দফায় সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকেও ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছিল। রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ২(ক) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছিল, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সম-অধিকার নিশ্চিত করবে।
৫১ দফায় আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করে তার ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা সংবলিত বিতর্কিত টেলিগ্রাম এবং ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। দেশে-বিদেশে সকল সরকারী অফিস, দূতাবাস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি ঝোলানো ও প্রদর্শন করা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’ এবং নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে পরিচিত হবে। ৫১ দফায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ (২-ক) পরিচ্ছেদ (অনুচ্ছেদ ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ও ৫৮ ঙ) বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। এর অর্থ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যাবে। ৭(খ) অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিধানগুলোকে সংশোধনের অযোগ্য ঘোষণার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যার অর্থ, ভবিষ্যতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর কোনো সংশোধন করা যাবে না।
সংসদীয় বিশেষ কমিটির সুপারিশ গ্রহণের আড়ালে এভাবেই সংবিধানকে একশ’ভাগ আওয়ামীকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভা। অন্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছিল বিশেষ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে। কারণ, এর পেছনে রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ইতিহাস। একটি রিট আবেদনের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ২৪ আগস্ট হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছিল। সে রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়েছিল সে বছরের ১ মার্চ। ১৬ মে বিদায় নেয়া প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চকে সহায়তা করার জন্য ১০ জন সিনিয়র আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়েছিল।
তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, বিচারপতি টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ড. এম জহির, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি প্রমুখ শুনানিতে বক্তব্য রেখেছিলেন। কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করলেও ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ছাড়া বাকি অ্যামিকাস কিউরিদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু দিনের পর দিন ধরে সংবিধানসম্মত ব্যাখ্যা ও বক্তব্য শোনার পরও একদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছিল, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছিলেন। অথচ অজুহাত হিসেবে যে রায়কে অবলম্বন করা হয়েছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে চিহ্নিত সে রায়টি একই সঙ্গে স্ববিরোধিতাপূর্ণ হিসেবেও বিতর্কিত হয়েছে। কারণ, রায়ে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি, একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া এটা ছিল একটি বিভক্ত রায়। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সাত সদস্যের মধ্যে কতজন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন এবং তারা কী অভিমত দিয়েছিলেন সেকথাও আজ পর্যন্ত অপ্রকাশিত রয়েছে। বড় কথা, রায়ের নামে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু সরকার সে পদক্ষেপই নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলে বসেছিলেন, আদালত অবৈধ ঘোষণা করায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার নাকি ‘আর কোনো সুযোগ নেই’! প্রধানমন্ত্রী কিন্তু সংক্ষিপ্ত আদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয়া অভিমতটুকুর উল্লেখই করেননিÑ যেখানে বলা হয়েছিল, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
এভাবে সব মিলিয়েই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সংবিধানের নাড়ি ধরে টান মারার পাশাপাশি সংবিধানের খোলনলচে পাল্টে ফেলারও পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ উদ্দেশ্যে ক্ষমতাসীনরা এমন এক সাবেক প্রধান বিচারপতির তৈরি করা পথে পা বাড়িয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করার অভিনয় করে যিনি দেশের সংবিধানকেই ‘লন্ডভন্ড’ করে ফেলেছেন। ক্ষমতাসীনরা ওই বিচারপতির প্রকৃত উদ্দেশ্যসহ অন্য কোনো সম্ভাবনাকে বিবেচনায় পর্যন্ত নেননি। তারা ভাবতেই চাননি, খায়রুল হক আসলে অন্য কোনো গোষ্ঠীর জন্য ‘পথ পরিস্কার’ করে গেছেন কি না। কারণ, এই বিচারপতির দেয়া রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করতে গেলে রাজনৈতিক সংকট যেমন ঘনীভূত হতে পারে, তেমনি বিঘিœত হতে পারে ‘দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা’ও। আর এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগই সাধারণত ‘উদ্দিন’ সাহেবরা নিয়ে থাকেন। তারা আওয়ামী লীগের ‘আন্দোলনের ফসল’ হিসেবে দেশের বিশেষ এলাকা থেকে এসে হাজির হন এবং বেগম খালেদা জিয়ার মতো দেশপ্রেমিক নেতা-নেত্রীদের ‘মাইনাস’ করে থাকেন। এজন্যই বলা হয়েছিল, ‘ভাবিয়া করিও কাজ’!