‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।/আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়/অবতার শ্রীরামচন্দ্র যে জানকীর পতি/তারও হলো বনবাস রাবণ-করে দুর্গতি।/আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়/,মহারাজা শ্রীহরিশচন্দ্র রাজ্যদান করে শেষ /শ্মশান-রক্ষী হয়ে লভিল চণ্ডাল বেশ।’
একাব্বর মিয়া যেদিন নজরুলের এই গানটি প্রথম শোনে সেদিন তার মনে হয়েছিল তার দাদা বরুইহাটির জমিদার সোলেমান মিয়া যদি গানটি শুনতেন তাহলে আজ তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান এমন পর্যায়ে পৌঁছাত না। এক সময় মিয়া পরিবারের ক্ষমতার দাপট এর কথা জানে না বা শোনেনি এমন লোক এ তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একাব্বর মিয়ার দাদা ছিলেন স্বনির্মিত স্বশিক্ষিত জোতদার। করটিয়ার জমিদার পন্নী পরিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্রে ছিল সখ্যতার সম্পর্ক। এই সম্পর্ক মাঝে মধ্যে এমন উচ্চতায় পৌঁছাত যে, সোলেমান মিয়া নিজেকে নিয়ে অসম্ভব আত্মম্ভরিতায় ভুগতেন। ধরাকে সরা জ্ঞান করার তার প্রবণতা তার নায়েব পেয়াদাদের মধ্যে এমনভাবে সংক্রমিত হয় যে রায়তদের পাত্তা না দেয়াটা তাদের স্বভাবে পরিণত হয়। জমিদার সোলেমান সব সময় রায়তদের উন্নতির কথা মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে কোন কর্মসূচি প্রজা কল্যাণপ্রদ ছিল না। বরং প্রজাকল্যাণের নামে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে করণীয় কিছুই তিনি করেননি।
সোলেমান মিয়া ইবরাহীম খাঁ সাহেবের হাইস্কুলে পড়তে যাবেন যাবেন এমন সময় শুনলেন চান মিয়াকে ইবরাহীম খাঁ সাহেব স্কুলের পরিবর্তে কলেজ চালু করাতে রাজি করিয়েছেন। সোলেমান মিয়ার স্কুলে পড়ার ইচ্ছে উবে গেল। স্কুল বাদ দিয়ে তিনি কলেজে পড়বেন কেমনে? কোনো মতে মক্তব ও প্রাইমারি সবে শেষ, মাঝখানে হাইস্কুলে ৫-৬ বছর কোথায় কিভাবে পড়বেন এই চিন্তায় তার আর ইব্রাহীম খাঁ সাহেবের কলেজ ধরা হয়ে উঠল না। দেখ গেল মিয়ার পো’র এ নিয়ে ক্ষোভ বা দুঃখ তার কোনোটাই নেই। অটো পাসে গিয়েও কিছু হলো না দেখে তিনি জোতের জমির দেখাশুনায় মন দিলেন। দুই দু’টি পরগনার জমি বন্দোবস্তও পেলেন। বরুইহাটির যে জায়গায় এখন কম্যুনিটি ক্লিনিক সেখানটা আগে বড় পুকুর ছিল। সেই পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে একাব্বর মিয়ার ছোট চাচা আলী হোসেন মিয়া ডুবে মারা যান। দুঃখে শোকে বিছানা নিলেন সোলেমান মিয়া। একাব্বরের বয়স তখন তিন কি চার। তার পিতা নূর হোসেন মিয়া তখন কলকাতা রিপন কলেজ থেকে এলএলবি করে ফিরে এলেন। ময়মনসিংহ বারে যোগ দিলেন। বসির হাটের শহীদুল্লাহ্ সাহেব তখন বারে। ভীষণ পড়–য়া ও পণ্ডিত ব্যক্তি। সখ্যতায় শহীদুল্লা নূর হোসেন সমানে সমান। হঠাৎ একদিন আশুতোষ মুখার্জির কাছ থেকে তার পেলেন শহীদুল্লাহ্। শহীদুল্লাহ্, বার ইজ নট ফর ইউ কাম টু আওয়ার ইউনিভার্সিটি। ইবরাহীম খাঁ সাহেবও এক সময়ে ময়মনসিংহ বারে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও টিকলেন না। চান মিয়ার সাথে শলাপরামর্শ করে করটিয়ায় ফিরলেন প্রথমে স্কুল পরে কলেজ করলেন। নূর হোসেনের বাবা সেই কলেজে পড়তে চেয়েও পড়তে পারেননি। তবে নূর হোসেনকে তিনি পড়িয়েছেন কলকাতায় রিপন কলেজে।
একাব্বর মিয়াও তার দাদার মতো বেশি পড়াশুনা করতে পারেননি। বরুইহাটির লোকসানি জোত জমি দেখাশুনায় মন তার। এই জমি জমা দেখা যে কি দারুণ ঝক্কি-ঝামেলা তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পান। তিনি বুঝতে পারেন মানুষের মধ্যে আচার-আচরণে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ’৪৭ সালের ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বায়ান্নোয় পা দিয়েছে। একাব্বর মিয়া দেখে কত লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে, আবার তিনি এটাও দেখেছেন সম্ভ্রান্ত কত পরিবার নিঃস্ব হতে হতে হারিয়েই গেছে। একাব্বর মিয়ার বাবা পাকিস্তান আন্দোলনে নাম লিখিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের অবসরে দেখে ছিলেন নানান রশি টানা টানিতে পাকিস্তানের বারোটা বাজতে শুরু করেছে। নূর হোসেন স্থানীয় সরকারের পদ-পদবি পাওয়ার ইচ্ছে করেও পদ পাননি। সবাই কেমন যেন বদলিয়ে যাচ্ছে দেখে হতাশায় ভুগে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংবিধান গৃহীত হবার দিন মারা যান নূর হোসেন। সংসারের ভার তখন একাব্বর মিয়ার ওপর। তার দেশ বড় হতে শুরু করেছে। একাব্বর মিয়া চেয়ে চেয়ে দেখলেন, তার বলার কিছু ছিল না। কিন্তু তার দু’হাত ভরে দেশের জন্য ভালোবাসা ছিল। দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবেসে তিনিও গড়তে শুরু করলেন একে একে নানান প্রতিষ্ঠান। সেখানে চাকরি করে শত শত লোক অধিকাংশ নারী। ব্যাংকে লেনদেন কোটি কোটি টাকার। ট্যাক্সও দেন ভালো। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল একাব্বর মিয়া হঠাৎ ধপাস করে পড়ে গেলেন। গেলেন তো গেলেনই নানান প্যাঁচে পড়ে। তিনি এখন কোনো জায়গায় যেন পাত্তা পান না। কে কোত্থেকে যে এসে জুটেছে জটাজালে বলা মুশকিল। একাব্বর মিয়া তার আফসোস আক্রোশ ও আশাহত হবার একটা ব্যাখ্যা পেলেন নজরুলের এই গান থেকে। একাব্বর মিয়া চোখের সামনে দেখছেন কিভাবে সমাজে মল্লযুদ্ধে ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা সবার। কাউকে এখনো বোঝানো যাচ্ছে না নিজেরা নিজের শত্রু সেজে সাজানো সংসারে কেন এই তেলেসমাতি। দেশটা তো সবার। ঝগড়া ঝাঁটি করে নিজেদের বলক্ষয়। রবীন্দ্রনাথ জাপানি জাতির আত্মশক্তি বিকাশের কারণ ও জায়গাটি শনাক্ত করেছিলেন। তিনি জাপান যাত্রীর পথে লিখেছেন- ‘জাপানিরা বাজে চেঁচামেচি করে বল ক্ষয় করে না, ফলে প্রয়োজনের সময় টানাটানি পড়ে না।’
সঙ্গত ও স্বাভাবিক কারণেই, একাব্বর মিয়ার মনে প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক অর্থনীতির এই মারপ্যাঁচে তার ঠেকে শেখার কি কোনো শেষ নেই? ঠেকে শিখতে শিখতে তার প্রজন্ম শেষ হয়ে পরের প্রজন্মের মধ্যেও এর দুঃখজনক প্রভাব চলতে থাকবে বলে আশঙ্কা। সেই আদি পিতা হজরত আদম ইবলিস শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করেছিলেন। প্রভু নিরঞ্জনের নির্দেশ উপদেশ উপেক্ষা করে সম্পাদিত সেই ভুলের খেসারত হিসেবে স্বর্গ হতে বিদায় নিতে হয়েছিল প্রথম মানব মানবীকে। অনেকেরই ধারণা, এমনতর অসতর্ক না হলে, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল না করলে, এমন নির্দেশ অমান্যের ঘটনা না ঘটলে আজ সবাই স্বর্গে স্থায়ীভাবে বিনা দলাদলিতে বিনা সঙ্কট সন্ত্রাসে সংশয়ে বাস করা যেত। যা হোক আদি মানবের করা প্রথম নির্দেশ অমান্যের ঘটনা থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে যত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অন্তর্ঘাত, অপশাসন, আইনের বরখেলাপ, চোরাগোপ্তা হামলা, ডাকাতি, পুকুর এবং সাগর চুরি, প্রবঞ্চনা-প্রতারণা, ডলার (কৃত্রিম) সঙ্কট, দুর্নীতি দুঃশাসন স্বৈরাচার সব কিছুর সালতামামি ও শুমার করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় অনেকেরই, অধিকাংশেরই ‘ঠেকে শেখা শেষ হয়নি’, অর্থাৎ তাঁরা উপযুক্ত শিক্ষা পাননি বা নেননি। অনুপযুক্ত ওরফে কুশিক্ষার কারণে একেকটি দুর্ঘটনা ঘটে, দোষারোপের দোদুল্যমানতায় এমন ভুল ঘটনা আর ঘটবে না, এমন পথে পা বাড়ানো হবে না, এমন কিছু আর করা হবে না এ ধরনের প্রতীতিতেও ঘটছে বিপত্তি। আজ যারা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন, ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা বা পথপন্থা শুরু করেন তাতে কখনো সখনো মনেও হয় সবকিছুতে এমন সুরক্ষা লাভ ঘটবে যে তাতে শনৈ শনৈ গতিতে উন্নতির পথে সবাই যাবে বা থাকবে। কিন্তু এ রকম প্রবোধ, প্রত্যয় অতীতে অনেক ঘটনার পরপরই নেয়া হয়েছে কিন্তু বিপর্যয় ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটা থেমে থাকেনি। অতীতে অর্জিত তিক্ত অভিজ্ঞতা, সে সময় নেয়া প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞা পারতপক্ষে তেমনভাবে থামিয়ে দিতে পারেনি ভাবী কালের অঘটন ঘটন সঙ্ঘটনকে। আদি ভাই কাবিলের হাতে তার একমাত্র ভাই হাবিলের মৃত্যুতে মা হাওয়ার বুক খালি হওয়া থেকে শুরু করে এই কিছুক্ষণ আগেও পৃথিবীর কোথাও কোথাও কোনো না কোনো মায়ের বুক সহসা খালি হওয়ার মতো মর্মবিদারক ঘটনা ঘটছে। ঠেকে শেখা শেষ হয়নি। উচিত বা উপযুক্ত শিক্ষা পেতে সময় লাগলেও পরবর্তীকালে তা উপলব্ধির ক্ষেত্রেও চলেছে মর্মান্তিক মরাকাটাল।
একাব্বর মিয়া ভেবে পায় না সবাই কিভাবে নিজের পায়ে নিজেরা দাঁড়াবে। দীর্ঘদিনের অবহেলা আর অবজ্ঞার ফলে দেশ সমাজ ও অর্থনীতিকে কিভাবে চাঙ্গা করে তোলা হবে, কিভাবে সমাজজীবন থেকে বন্ধ্যানীতি কুসংস্কার আর অপয়া ভাবধারা অপসারিত করে আত্মবিশ^াসের বিকাশ ঘটিয়ে জাগ্রত জাতি সভায় বাংলাদেশের অবস্থান ও গৌরবকে আরো ঐশ্বর্যমণ্ডিত করার সে চেতনা জাগাতে পারে সৃজিত মূল্যবোধগুলো। আমাদের ইতিহাস ও ঘটনা পরিক্রমা এই প্রতীতি জাগাতে পারে যে আমরা গণতন্ত্রমনা, আমরা আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় একাগ্র, আমাদের কর্তব্য পালনে আমরা নিরলস এবং অনন্য ঐক্যে বিশ্বাসী ও ধাতস্থ। সুতরাং বাংলাদেশে আমাদের মূল্যবোধগুলো, মুক্তিযুদ্ধকালীন একাগ্রতা, আত্মত্যাগের সুমহান সংকল্প নিশ্চয়ই একই ভূমিকা পালন করবে আমাদের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে সবাই উদ্যোগী হবে। কোনোক্রমেই এসব মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়ে বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ায়, দায়িত্বহীনতায়, অলসতায়, একে অন্যের দোষারোপের অবয়বে নিজেদের বিলীন করে দেবার প্রবণতা যেন দেখা না দেয়।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ এই একাগ্রতার পরিচয় দিতে যে পিছপা হয়নি, সত্যই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়নি তার সাফল্যগাথা যেমন আছে তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে চরিত্রবলের অধঃপতন ও ন্যায়নীতিনির্ভর মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণ থেকে উৎসারিত দুর্নীতি জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মপ্রয়াস মন্থর করে দেয়ার, অদূরদর্শী পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার বিঘ্ন ও বিভ্রাট সৃষ্টি হওয়ার বিষয়গুলোকে যথাসচেতনতায় সজাগ দৃষ্টি দেবার অবকাশও রয়েছে।
সুতরাং অতীত আঁকড়ে ধরে থেকে নয় বরং অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে উন্নয়নের সাফল্যকে জীবনের সর্বস্তরে উদ্ভাসিত করে তোলার জাগ্রত চেতনায়, সমাজকে পরিচ্ছন্ন করে তোলার ব্রত নিয়ে নিজস্ব ভৌগোলিক সীমানায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে দেশিক আশা আকাক্সক্ষার ভিত্তিতেই এ দেশ গড়ে তোলার মহান অনুপ্রেরণার সঞ্চারী হোক সবার প্রত্যয়।
সবারই বোঝা দরকার, চিরদিন কারো সমান যায় না।
লেখক : উন্নয়ন-অর্থনীতির বিশ্লেষক