সারাদেশে গত এপ্রিল মাস থেকেই তীব্র গরম পড়তে শুরু করেছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মে মাসে বৃষ্টিপাতের আশা করেছিলেন। কিন্তু মে মাসও তীব্র গরমে কেটেছে। এই দুই মাসে সারাদেশে হিট স্ট্রোক করে ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ফোরাম। এর মধ্যে একজন শিশু, পাঁচ জন নারী এবং ১৪ জন পুরুষ রয়েছেন। বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ।
সংগঠনটি জানিয়েছে, সারাদেশের ওপর দিয়ে গত ২ মে থেকে শক্তিশালী তাপপ্রবাহ প্রবাহিত হচ্ছে। তীব্র এই গরমে কিছু ভুল পদক্ষেপ বিপদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই সময় নিরাপদ পানি পান করা, বাইরের খাবার পরিহার করার পাশাপাশি কিছু সতর্কতা বড় ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রয়োজনের বাইরে মানুষকে ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। প্রচ- গরমে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তীব্র তাপপ্রবাহে দিনের পর দিন বাইরে থাকলে বা কাজ করলে হিট এক্সহশন বা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। হিট স্ট্রোকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অস্টিনের মেডিসিন পালমোনারি ক্রিটিকাল কেয়ার বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুমি আহমেদ খান বলেন, হিট স্ট্রোক একটা মেডিকেল ইমার্জেন্সি। সময়মতো দ্রুত চিকিৎসা না করালে মৃত্যুর সম্ভাবনা খুব বেশি।
ডা. রুমি বলেন, এই গরমে বেশিক্ষণ বাইরে থাকার কারণে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আমাদের শরীর খুব তাপমাত্রা সেনসিটিভ। তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে আমাদের শরীর বিভিন্নভাবে তাপমাত্রা কমাতে কাজ শুরু করে দেয়। এর প্রধানতম পদ্ধতি হচ্ছে ঘাম তৈরি। যখন আমাদের বডির সারফেস থেকে ঘাম ইভাপোরেট হয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনে। তবে এই ঘামের মাধ্যমে তাপমাত্রা কমানোর একটা লিমিটেশন আছে। হিউমিডিটি যদি ৭৫% এর বেশি হয় তাহলে এই পদ্ধতি খুব একটা কাজ করে না।
গরমে যে ধরনের অসুস্থতা: তীব্র গরমে অসুস্থতার প্রথম ধাপে যা হয়, তা হচ্ছে হিট ক্র্যাম্প। অতিরিক্ত ঘামের কারণে লবণ ও পানির অভাব হয় এবং এর প্রভাবে মাসল (বিশেষ করে পায়ের) মাসল ক্র্যাম্প (কামড়ানো) শুরু করে। এরপর হচ্ছে এক্সহশন।
হিট এক্সহশন এক দফায় হিট এক্সপোজার এর কারণে না হয়ে অনেক দিনের কিউমিলিভ এফেক্টেও হতে পারে। যেমন, আপনি পর পর তিন চারদিন দ্ইু-তিন ঘণ্টা করে বাইরে গরমে থাকলেন। পঞ্চম দিনে গিয়ে আপনার হিট এক্সহশন এর উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বয়স্ক, অতিরিক্ত কম ওজন সম্পন্ন ব্যক্তি, শিশু, গর্ভবতী ও উচ্চ রক্তচাপে ভোগাদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি। হিট এক্সহশন এর লক্ষণ হচ্ছে, অতিরিক্ত ঘাম হওয়া, দুর্বলতা, মাথা ধরা, মাথা ব্যথা, বমিবমি ভাব আর ফেইন্ট ভাব হওয়া। থার্মোমিটার দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখতে পারেন হিট এক্সহশন নিশ্চিত হওয়ার জন্য। হিট এক্সহশন এর একপর্যায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ও হার্ট রেট দ্রুত হতে শুরু করবে। হিট এক্সহশনে আক্রান্ত ব্যক্তিকে প্রথমে ছায়ায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. রুমি আহমেদ খান। এরপর রোগীর রিহাইড্রেশন শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে ওরস্যালাইন সবচেয়ে ভালো। শুধু ঠা-া পানি হলেও চলবে প্রথমে।
আশপাশে পুকুর থাকলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে গলা পর্যন্ত পুকুরের পানিতে নামিয়ে দিন। পুকুর না থাকলে বাথটাবে শুইয়ে দিন এবং পানির মধ্যে কিছু বরফ ঢেলে দিন। তাও না থাকলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করিয়ে দিন তারপর টেবিল ফ্যান দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন। টেম্পারেচার না নামলে আবার ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে দিন এবং টেবিল ফ্যানের সর্বোচ্চ গতি দিয়ে শরীর শুকিয়ে দিন। মনে রাখতে হবে, ঠা-া পানির রিহাইড্রেশন খুব জরুরি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, শুধু পানি অতিরিক্ত খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। সেজন্য ওরস্যালাইন উপকারী।
যদি হিট এক্সহশন এর ঠিকমতো চিকিৎসা করা না যায়, অথবা ডায়াগনোসিস করা না যায় তাহলে হিট স্ট্রোক হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি বলে জানান ডা. রুমি আহমেদ খান। তিনি বলেন, যদি দেখেন স্কিন শুকনা লাল হয়ে গেছে; ঘাম হচ্ছে না, পালস হাই হয়ে গেছে, রোগী উল্টা-পাল্টা কথা বলছে অথবা কোনো কথা বলছে না, কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে হিট স্ট্রোক হতে পারে। তিনি আরও বলেন, এর পরের ধাপে একের পর এক অর্গান ফেইল করা শুরু করবে। প্রথমে ব্রেইন এর নিউরোনগুলো ড্যামেজ হবে, এরপর আমাদের লিভার ও রক্তনালীর সেলগুলোর ড্যামেজ শুরু হবে। ইভেঞ্চুয়ালি সব অর্গানই ফেইল করবে। রোগী এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে উপরের স্টেপগুলো তো নিতে হবেই, পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব আইসিইউ আছে এমন হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এই গরমে যত হালকা পাতলা খোলামেলা পোশাক পরা যায় তত ভালো। তবে আমাদের ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজে নারীদের জন্য এই অ্যাডভাইসটা তো প্র্যাকটিকাল না। ওনাদের এই সময়গুলোতে ঘরের বাইরে বের না হওয়াটাই নিরাপদ। আরেকটা কথা, নারীরা কিন্তু ঘরের ভেতরেই রান্নাঘরে একটা রিস্কি এনভায়রনমেন্ট আছেন। গরমের দিন রান্নাঘরের তাপমাত্রা অন্যান্য রুমের চেয়ে অনেক বেশি। এই ব্যাপারটাও অনুগ্রহ করে মাথায় রাখবেন।