চারদিকে নেই আর নেই। এমন নেতিবাচক বক্তব্যতেই চলছে সেবামূলক তিন খাত গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি নিয়ে। আর সরকারের এমন ‘নেই’ খেলার মাশুল দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। কোথাও পানি নেই, কোথাও কিছুটা আছে। নেই তো নেই-ই। যেখানে আছে অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। এদিকে সংযোগ থাকলেও বেশিরভাগ সময় অনেক এলাকায় থাকছে না গ্যাস। থাকলেও চাপ কম। আবার বিদ্যুতে দিনভর চলে লুকোচুরি খেলা। আসা আর যাওয়ার মধ্যেই চলছে ২৪ ঘণ্টা। নাম তার লোডশেডিং। এ তিন যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। তিন সংকটই পুরোনো, কিন্তু সমাধান নেই। কর্তৃপক্ষ আছেন। কিন্তু সংকট সমাধানে তাদের নজর কতটুকু, সেই প্রশ্ন এখন ভুক্তভোগীদের।
সূত্র মতে, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংকটে চরম ভোগান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছেন রাজধানীবাসী। গত ৬ জুন প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল। গত কয়েকদিনে কখনো সেই ঘাটতি বেড়েছে আবার কখনো কিছুটা কমেছে। ঘণ্টার মধ্যে একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে। গ্যাস সংকটে বাসাবাড়িতে রান্নার সমস্যা কাটছে না। পানির সমস্যা আরও ভয়াবহ। রাজধানীর অর্ধেক এলাকায় পানি সংকট প্রকট। অভিযোগ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। অন্যের উপর দায় চাপিয়ে পার পাবার চেষ্টা সংস্থাটির কর্মকর্তাদের। ঢাকা ওয়াসা লোডশেডিংয়ের কারণে চাহিদা অনুযায়ী পানি উৎপাদন এবং সরবরাহ করতে না পারায় রাজধানীর অর্ধেক এলাকাতেই দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। ট্রাকে পানি সাপ্লাই এবং জেনারেটরে পাম্প চালানোর মতো আপদকালীন বিভিন্ন ব্যবস্থা রাখলেও তাতে সমস্যা মিটছে না নগরবাসীর। ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগুজে সক্ষমতার গল্প না বলে বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করে এর প্রতিকারে কাজ করা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান মিলবে না। ওয়াসার একটি সূত্র জানিয়েছে, মডস জোন ৩ এর নীলক্ষেত ও আজিমপুর, জোন ৫ এর মহাখালী, কাওরান বাজার ও তেজগাঁও, জোন ৬ এর ফকিরাপুল, মগবাজার ও রামপুরা-বনশ্রী, জোন ৯ এর নিকুঞ্জ,খিলক্ষেতও উত্তরা মডেল টাউন এবং জোন ১০ এর মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় পানি সরবরাহ চাহিদার তুলনায় অনেক কমে গেছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার কিছু গৃহপালিত মিডিয়া কর্মীর উপস্থিতিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে লোডশেডিংয়ের কারণে কয়েকটি জোনে পানি সরবরাহে সংকট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তিনি জানিয়েছেন, ঘন ঘন বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আশ্বস্ত করে বলেন, ঢাকা ওয়াসার উৎপাদনের ইকুইপমেন্ট বা যন্ত্রপাতিতে কোনও সমস্যা নেই। শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি না পাওয়ার একমাত্র কারণ লোডশেডিং। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও পানি সরবরাহ করতে ৪৮টি গাড়ি এবং জেনারেটর দিয়ে পাম্পগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর আজিমপুরে বটতলা এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে এক ঘণ্টাও পানি পাচ্ছেন না এলাকাবাসী। মগবাজার মধুবাগ এলাকায় গত দুই সপ্তাহ ধরেই চলছে পানির সংকট। এ ছাড়া বনশ্রী, কলাবাগান, পরীবাগ, শাহজাদপুর, খিলগাঁওসহ পুরো রাজধানীজুড়েই দিনের বেলা থাকছে পানির সংকট। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ওয়াসার আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে একাধিকবার অভিযোগ করেও কোনও প্রতিকার মিলছে না। আবার ওয়াসা পানির গাড়ি পাঠাবে বলেও পাঠাচ্ছে না। খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকার বাসিন্দা আশরাফ আলী জুয়েল বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পানি সরবরাহ নেই। অভিযোগ করেও সমাধান পাচ্ছি না। প্রতিদিন ওয়াসার গাড়ি থেকে পানি কিনে নিতে হচ্ছে। আবার কেনা পানিও সবসময় পাওয়া যাচ্ছে না। মগবাজার এলাকার একটি মেসে অবস্থান করা শিক্ষার্থী আনজুম আরা জানান, গত কদিন ধরে পানির সংকট চলছে। প্রায় প্রতিদিন সকালে পানি থাকে না, গোসল করার জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগে।
ওয়াসা বলছে, তাদের দৈনিক পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২৬০ কোটি লিটার। ঢাকা শহরে ২১০ থেকে ২৪৫ কোটি লিটার পর্যন্ত চাহিদা থাকে। সংস্থাটির দাবি, ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে পানির চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। চাহিদার তুলনায় ওয়াসার পানি উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি থাকলেও এমন পরিস্থিতি কেন হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াসার একজন বোর্ড মেম্বার জানান, গত এক সপ্তাহে ওয়াসার ৯১৪ পাম্পের মধ্যে জেনারেটরহীন ১৭০টি পাম্প বিদ্যুৎ বিভ্রাটজনিত কারণে ৩১৫ ঘণ্টা বন্ধ থেকেছে। বিভিন্ন মডস জোনে পাম্পগুলো অকেজো হয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে এগুলো সংস্কারও হচ্ছে না। তিনি বলেন, ওয়াসার সক্ষমতার গল্প শুনে তো মানুষের চাহিদা মিটবে না। ওয়াসা এমডির উচিত টেকনিক্যাল সমস্যাগুলো স্বীকার করে এগুলোর প্রতিকারে কাজ করা। তা না হলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা মিটলেও পানি নিয়ে মানুষের ভোগান্তি মিটবে না।
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় পানি নিয়ে তীব্র অসন্তোষ। উত্তরা ১২ সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের বাসিন্দা মো. আউয়াল। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, এক দিকে ভয়াবহ লোডশেডিং চলছে, অপরদিকে মিলছে না ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি। কিনতে চাইলেও পাওয়া যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে নানা অজুহাত। আবার অনৈতিক পন্থায় কেউ কেউ দ্রুত পানি নিচ্ছে বলে রয়েছে অভিযোগ। এ এলাকায় গ্যাসের সংকটও আছে জানিয়ে মো. আউয়াল বলেন, বিদ্যুৎ-পানি সমস্যার পাশাপাশি গ্যাসের সমস্যাও রয়েছে তীব্র। মৌলিক এ তিনটি বিষয় সমস্যা চলমান থাকলেও এর সমাধানে দেখা যাচ্ছে না তেমন কোনো উদ্যোগ।
ওয়াসা মডস জোন-৯ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুজাহিদুর রহমান বলেন, লোডশেডিং সমস্যায় আমরা এক এলাকায় পানি দিলে অন্য এলাকায় দিতে পারি না। তাছাড়া পানি কোথা থেকে এনে দিব সেই সমস্যাটিও প্রকট। প্রায় সব এলাকায়ই পানির সংকট চলছে। তিনি বলেন, পানির এ সংকট সমাধানে কাজ চলছে। শিগগিরই সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি। এলিফ্যান্ট রোডের গৃহিণী রোকেয়া আক্তার বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়। বিশেষ করে রাতের লোডশেডিং জীবনকে অসহনীয় করে তোলে। লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি আছে পানি সংকটও। মাঝেমাঝেই দেখা দেয় গ্যাসের তীব্র সংকট। গত সোমবার সকাল ১০টায় রান্না করতে গিয়ে তিনি দেখেন, চুলায় গ্যাসের সংকট। নিভু নিভু জ্বলে। চায়ের পানি গরম হতেই তার সময় লাগে প্রায় আধাঘণ্টা। বিরক্ত হয়ে তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে গ্যাসের এ সংকটে ঠিকমতো রান্না করাও কঠিন হয়ে পড়ে। ভাত ও তরকারি রান্না করতে ১ ঘণ্টার জায়গায় সময় লাগে ২ থেকে ৩ ঘণ্টারও বেশি। এ সমস্যা মাঝেমধ্যেই হয়।
কামরাঙ্গীরচরের মুসলিমবাগ এলাকায় ২০০৬ সাল থেকেই গ্যাসের সংকট, যা বর্তমানে তীব্র। চলমান লোডশেডিংকালে এর অবস্থা আরও ভয়াবহ। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গ্যাসের যা সাপ্লাই দেয়া হয়, তার সিংহ ভাগ বিভিন্ন কারখানার মালিকরা গ্যাসের মূল পাইপলাইনের সঙ্গে চুরি করে সংযোগ দিয়ে তাদের কারখানায় নিয়ে যান। এতে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। স্থানীয় বাসিন্দা সাফিয়া বেগম জানান, গ্যাস পাওয়া যায়, তবে টিপ টিপ করে জ্বলে। গ্যাস থাকে, তবে তারও চাপ খুবই কম। ফলে সিলিন্ডারের এলপিজি গ্যাস অথবা লাকড়ি দিয়ে রান্নার কাজ করতে হয়। গ্রীষ্মকালে কিছুটা গ্যাস মিললেও শীতকালে দেখাই মেলে না। এ সমস্যা কামরাঙ্গীরচরের বেশিরভাগ এলাকার হলেও মুসলিমবাগে তুলনামূলক বেশি। তবে গ্যাস না পেলেও প্রতিমাসে গ্যাস বাবদ বিল তাদের গুনতে হচ্ছে ঠিকই। ফলে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এখন গ্যাস বিল দিতে অনিহা প্রকাশ করছেন। সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা হয়েও ওয়াসার পানি থেকে বঞ্চিত এ এলাকার মানুষ। ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতোই কামরাঙ্গীরচরেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই বলে জানান এ এলাকার বাসিন্দারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউন, দক্ষিনখান, উত্তরখান, খিলক্ষেত, পূর্ব রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ি, মগবাজার, খিলগাঁও, গোড়ান, কালাচাঁদপুর, নতুন বাজার, বাউনিয়া বাঁধ, উত্তর ইব্রাহিমপুর, কদমতলী, শ্যামপুর, মিরপুর-১০, পীরেরবাগ, বড়বাগ, কাজীপাড়া, আগারগাঁও, আরামবাগ, মানিকনগর, কালাপানি, কালশী, পশ্চিম মনিপুর, মুরাদপুর, কেদার নাথ দে লেন, মোহাম্মদপুর ও বাড্ডাসহ অনেক এলাকায় পানির সংকট রয়েছে। এদিকে গ্রীষ্মের শুরু হতে না হতেই রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকায় দেখা দিয়েছে প্রচ- দাবদাহের পাশাপাশি তীব্র লোডশেডিং। এসব এলাকায় এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুৎ থাকে না। তবে শুরুতেই এ সংকট খুব একটা বেশি না হলেও গরমের তীব্রতা যতই বাড়ছে, ততই লোডশেডিংও বাড়ছে বলে দাবি ভুক্তভোগীদের। ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, বারিধারা, উত্তরা ও মতিঝিল দেশজুড়ে লোডশেডিং-এ ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্যাস আর কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ডলারের অভাবে কয়লা ও এলএনজি আমদানি সংকটের মুখে পড়ায় এ পরিস্থিতি। এ সংকট আরও কয়েক মাস চলবে।
গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ গ্যাস ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষেরা যেমন কষ্টে আছেন, তেমনি শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। দিনে প্রায় প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং করা হচ্ছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলো উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মুখপাত্র শামিম হাসান জানান, গত বুধবার সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আর উৎপাদন সক্ষমতা আছে ১৫ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। ১৮৯ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে। এটা দিনের পরিকল্পনা। রাতের চিত্র হয়ে যায় ভিন্ন। তিনি বলেন, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন গত ৫ জুন থেকে বন্ধ কয়লা না থাকার কারণে। আরেকটি আগে থেকেই বন্ধ আছে। এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। ফলে এটা বন্ধের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। আমাদের কিছু করার নেই। ডলার না পেলে আমরা কয়লা আনব কী দিয়ে।
রাজধানী ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) ও ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি)। ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী কাউসার আমীর আলী বলেন, তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসলে বিদ্যুতের চাহিদাও কমে যাবে। গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জানিয়েছে, তাদের এলাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে।