এটা কোনো নতুন কথা নয় যে, সভ্যতার বিকাশের ধারায় সমঝোতা-সিদ্ধান্তফরমান, বিধি-বিধান, আইন-কানুন মুখ্যত মানুষের কল্যাণেই রচিত হয়ে আসছে। এর অপব্যবহারে ব্যত্যয় হয়নি, বলা যাবে না। এমন সব অনিয়ম গোষ্ঠীর স্বার্থে হলেও বৃহত্তর মানুষের স্বার্থ, আকাক্সক্ষা, প্রয়োজন ও অভিপ্রায়কে অনেক ক্ষেত্রে পদদলিত করা হয়েছে। আমাদের এই জনপদেও বহু সমঝোতা-সিদ্ধান্ত আইন-কানুন রচিত হয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের কথা বলে। তবে সেসব আইন প্রয়োজন অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে কি না- সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না কখনো কখনো যে, ব্যক্তি গোষ্ঠীর স্বার্থকে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা একেবারে হয়নি। তা ছাড়া এ দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ অনেক সময় যেমন ঢিমেতালে চলেছে। তেমনি আইনের অপ্রয়োগও যথেষ্ট দ্রুত ও অধিক মাত্রায় অগ্রসর হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। একেবারে ছোট্ট একটা বিষয় তুলে ধরে বলতে চাই, এ দেশে আইনের প্রয়োগ নিয়ে কতটা উদাসীন আমাদের প্রশাসন। সম্প্রতি বিশ্বে তামাকের ব্যবহার কতটা ক্ষতিকর। তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন প্রচার চালিয়েছে। এমন প্রচারকে সবাই সাধুবাদ জানাবে, সন্দেহ নেই। তবে এ নিয়ে উপেক্ষা অনাগ্রহও আছে। এখানে আইনের একটা ছোট ব্যত্যয় তুলে ধরা হলে সবাই বুঝবেন, দেশে আইন কার্যকর করার কতটা উদাসীন দেশের প্রশাসন। বেশ কিছুকাল পূর্বে আইনের এক আদেশ জারি করা হয়েছিল। তাতে ছিল, যারা প্রকাশ্যে ধূমপান করবেন, তাদের জরিমানা করা হবে। তবে এই আদেশ প্রয়োগ কখনো হয়নি বলে অনেকে হয়ত ছোট এই ব্যবস্থার কথা এখন ভুলেই গেছেন। আইনটি ছিল এমন, কেউ প্রকাশ্যে পথে ঘাটে ও উন্মুক্ত স্থানে ধূমপান করলে কিছু টাকা জরিমানা হবে। কিন্তু এখনো পথে ঘাটে, বাজার-হাটে খোলা জায়গায় নায়কোচিত ভঙ্গি ও শৈলীতে নির্বিকারভাবে ধূমপান করছেন। অবশ্য এমন দৃশ্য বহু কিশোরকে ধূমপানে আগ্রহী করতে পারে। যেমন দেখার দেখ, শেখার শেখ।
গত ৩১ মে বিশ্ব তামাক দিবসে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকা ক্যান্সার সোসাইটি ও ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় ২০১৮ সালে এক জরিপ চালায়। জরিপে ২০০৪ সালের তথ্যের তুলনা করা হয়। এতে দেখা যায়, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের কারণে মৃত্যুর হার দ্বিগুণ হয়েছে: তামাক ব্যবহারজনিত নানা অসুখে বছরে এক লাখ ২৫ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের কিশোর থেকে প্রাপ্ত বয়স্কদের ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ তামাক ও তামাকজাতীয় পণ্য ব্যবহার করে বা মাদকে আসক্ত হয়েছে।
যাই হোক, আমাদের এই বক্ষ্যমান নিবন্ধের মুখ্য আলোচ্য বিষয় কিন্তু তামাক নিয়ে নয়। বাংলাদেশের আইন প্রয়োগের হাল অবস্থা কেমন সেটি নিয়ে। নিছক প্রাসঙ্গিক কারণে আলোচনা এখানে করা হয়েছে। এমন সব আইনের প্রয়োগ নিয়ে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ বেমালুম ভুলে থাকতে দেখা যায়। তবে নানা কিসিমের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের ক্ষেত্রে কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটলে তখন আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষণকাল অপেক্ষা করা হয় না। আসলে- এটাই দেশে আইন প্রয়োগের অপপ্রয়োগের এপিঠ ওপিঠ। দেশের অনেক দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে, আইনকে উপেক্ষা করা ও প্রয়োগ না করা কিংবা অপপ্রয়োগ করা।
শুধু আজ নয়, সেই গোড়া থেকেই এমনই ছন্দে দেশ চলে আসছে। অবশ্য বর্তমানে সব ক্ষেত্রে যেমন অহরহ বহু ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনৈতিক প্রশাসন আইনের প্রয়োগের চেয়ে অপব্যবহারের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার নজির হিসেবে সংবাদপত্রে অতি সম্প্রতি প্রকাশিত একটি খবরের এখানে উদ্ধৃত করা হলো। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান, ‘মানবাধিকার সংস্থা ফাউন্ডেশনের’ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আট মামলায় মে মাসে অন্তত ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৭ জনই বিএনপি নেতা। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মতপ্রকাশে বাধা, ভয় দেখানো, চুপ করানোর জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। এক মাসে অন্তত ৪৫ জন সাংবাদিককে অপমান, হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এই সংস্থার প্রধান হচ্ছেন সুলতানা কামাল। অপর জাতীয় দৈনিকের এক রিপোর্ট হচ্ছে, ‘রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ভয়াবহ পরিকল্পনা করছে। আমাদের কানে এসেছে, সাড়ে ১৩০০ মামলা চিহ্নিত করা হয়েছে, যে মামলাগুলো বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। আগামী নির্বাচনের আগে কিভাবে এই মামলাগুলো দ্রুত শেষ করে বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো যায়, সেই চেষ্টাই চলছে যাতে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছাড়া আওয়ামী লীগ খালি মাঠে গোল দিতে পারে। এই অভিযোগ থেকে এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, অতীতের মতো আইন ও বিধিবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভোটারবিহীন ও নৈশকালীন নির্বাচনের মতো করিয়ে নেয়া। সহজ কথা হচ্ছে, আজো আইনকে তার সরল পথে চলার ক্ষেত্রে প্রশাসক কর্তৃক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। বিএনপির মামলার যে ফিরিস্তি দিয়েছে, তাতে দেখা যাবে, এমন একটি মামলার কারণে অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ তার স্বজন সুহৃদ মিলে শতাধিক ব্যক্তিকে গভীর আতঙ্ক উৎকণ্ঠার মধ্যে পড়তে হবে। এমন সাড়ে ১৩ শত মামলাকে জাগিয়ে তোলা হলে কত শত মানুষকে যে কেমন অসহনীয় যাতনার মধ্যে ফেলে দেয়া হবে! সেই সব মানুষ শুধু কি যাতনার মধ্যে থাকবে? তাদের জীবন-জীবিকায় সীমাহীন বৈকল্য সৃষ্টি হবে নাকি?
বর্তমান সময়ে আরো অনেক বিষয় নিয়ে সর্বত্র আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। যেমন- মানবাধিকার, ন্যায়-নীতিবোধ ও গণতন্ত্রের পরিচর্যা করা। এসব আলোচনা থেকে এমন সব বার্তাই দেয়া হচ্ছে, এই মুহূর্তে এসব প্রশ্নের সুরাহা করা ভিন্ন অগ্রসর হওয়া ঠিক হবে না। অথচ প্রশাসন এসব বিষয়ে কেবল নির্বিকার নয় বরং দমননীতির পথে জোর কদমে অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে চাচ্ছে না, এসব যে, শাঁখের করাতের মতো যেতে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে যেমন কাটছে সে করাত ফেরার সময় শাসকদের কাটবে। এসব বিবেচনায় নিলে বলতে হবে ইতিহাসের এক জটিল অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। সমাজ রাষ্ট্রের বিধানাবলি যদি উপরোল্লিখিতভাবে তথা ভুল পথ ধরে চলতে শুরু করে, সে ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত গুরুতর সব সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্র। আর তার ফল হবে মানুষকে গভীর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করে ফেলা। আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গত দেড় দশকে যত বিষবাষ্প জমা হয়েছে, অনুমান করা খুব সহজ যে সম্মুখে সেটি কেবল ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। কারণ যত অনিয়ম অপপ্রয়োগ অপপ্রচার অসত্যের বিলাপ সব মাত্রাকে এখন অতিক্রম করে গেছে। প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে, প্রতিটি ক্রিয়ার অনিবার্য সম প্রতিক্রিয়ার জন্য মুহূর্ত অপেক্ষা করতে হয় না।
যারা এমন সব ক্রিয়া অহর্নিশ করছেন, তারা হয়ত তার প্রতিক্রিয়ার কথা খুব কমই ভাবছেন। সাময়িক লাভ ও স্বার্থের কথা বিবেচনা করে কেউ যদি খোশ হালে সময় কাটান; সে জন্য বলতে হচ্ছে তারা দূরদৃষ্টির ঘাটতির মধ্যে বেষ্টিত হয়ে আছেন। প্রশাসনিক সুশাসন বলে একটা কথা আছে, তার বিপরীত শব্দ অপশাসনই হয়ত। আমাদের বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার ব্যাকরণের দিক থেকে বিশ্লেষণ করলে কোনোক্রমেই তাকে সুশাসনের আওতায় ফেলা যাবে না। গত দেড় যুগ ধরেই সেই শৈলীকে অনুসরণ করা হচ্ছে বলে। আজ তার ষোলকলাই পূর্ণ হয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
এত সব ব্যত্যয় সম্মুখে থাকার জন্য শাসকদলের পক্ষ থেকে সম্ভবত বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন হবে চ্যালেঞ্জের। হয়ত এ কথাও ভাবা হচ্ছে, অতীতের মতো আগামী নির্বাচনের সময়, তাদের এসব চ্যালেঞ্জ ধামাচাপা দিয়ে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় ফিরতেই হবে এবার। সে জন্য এমন কথা নিয়ে আসা হচ্ছে, আমেরিকায় না গেলে এমন কী হবে আমাদের? এটা প্রকারান্তরে আমেরিকার ভিসানীতির একটা কঠিন জবাবই বলতে হবে। তবে এ কথাও ঠিক যে, ক্ষমতাসীনরা তাদের সব বক্তব্যেই স্থির থাকতে পারছেন না। কিছু পরেই ভিন্ন সুরে কথা বলা হচ্ছে। কঠিন থেকে কোমলে ফিরে আসা হচ্ছে। এমন পরস্পর সাংঘর্ষিক বক্তব্য থেকে এটি খুব পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
প্রশাসন খুব অস্থির চিত্র হয়ে উঠছেন। পূর্বাপর কী বলে চলেছেন সেটি আর ভাবার মতো মানসিক অবস্থানে তারা নেই। কিন্তু তারা কি এ কথাও ভাবছেন, এমন পরিস্থিতি শুধু তাদের জন্য নয়। দেশের পরিস্থিতিকেও কত দ্রুত অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। এখন সবারই উচিত শুধু নিজেদের নয়, সবার পক্ষে যাতে একটা সহজ পথ ধরা সম্ভব হয়। যে পথ দিয়ে সবাই সৃষ্ট পরিস্থিতিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার স্বাভাবিক একটা পথ পায়। জটিলতা সৃষ্টির সব চিন্তা থেকে শাসকদের সরে আসাই হবে এ সময়ে উত্তম সিদ্ধান্ত। হ
ndigantababar@gmail.com