দীর্ঘ দশ বছরেরও বেশি সময় পর ঢাকায় সরকারের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। নানা নাটকীয়তা ও বেঁধে দেয়া শর্তের মধ্যেই গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শান্তিপূর্ণভাবে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াত আয়োজিত সমাবেশে কয়েক হাজার নেতাকর্মী অংশ নেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সরকারের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ করে জামায়াত। এরপর থেকে দেশের কোথাও কর্মসূচি পালনে সরকারের অনুমতি মেলেনি বলে দলটির দাবি। তবে সময়ে সময়ে তারা অনুমতি ছাড়াই ঝটিকা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরামের মুক্তি এবং কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে গতকাল সমাবেশের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াত। সমাবেশে বক্তারা বলেন, বর্তমান সরকারের অধীনে দেশে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। আওয়ামী লীগের অধীনে অতীতে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। প্রয়োজনের তাগিদেই সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
চলমান সংকট সমাধানে সকল দলকে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে।
গতকাল দুপুর ২টায় কোরআন তিলাওয়াত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশনের মাধ্যমে সমাবেশ শুরু হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে। সংবিধান পরিবর্তন করে জনগণের দাবি মেনে তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান নির্বাচন। সেটা হতে হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। সেটা করতে হলে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করতে হবে। সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দিনের ভোট রাতে করে। লজ্জা তো ঈমানের অঙ্গ। কিছুটা তো লজ্জা থাকা উচিত নেতাদের। সুতরাং ২০১৪ ও ২০১৮ গেছে যাক। এবার ২০২৩/২৪ সালের নির্বাচনে আর সেভাবে যাবে না। যদি আওয়ামী লীগ বোঝে তাহলে আসুন আলোচনা করুন। এবারের নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। সে দাবি আদায়ে যা করা দরকার আমরা সেই আন্দোলন করবো ইনশাআল্লাহ। তাহের বলেন, আজকে দেশের শাসক ও মানুষ সৎ হলে ডোনার দেশ হতাম। কিন্তু সেটা করতে পারিনি। আপনারা না পারলে আমাদেরকে সহযোগিতা করুন। তাহলেই দেশের পরিবর্তন হবে।
সমাবেশের অনুমতি দেয়া ও শেষ পর্যন্ত সহায়তার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, জামায়াত কখনো বিশৃঙ্খলা করেনি, করেনা এবং করবে না। যদি হয় সেটা কেউ বাইরে থেকে করতে পারে, স্যাবোটাজ। জামায়াতে ইসলামী সন্ত্রাস, নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা এবং হামলায় বিশ্বাস করে না। জামায়াত দেশের তৃতীয় বৃহত্তম সুশৃঙ্খল আদর্শিক দল। রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা থাকেন তাদেরকে জামায়াত সম্পর্কে জানতে হবে। আজকে যারা সোনার বাংলা গড়তে ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা ব্যর্থ। সেখানে সোনার বাংলাদেশ ও সোনার নাগরিক তৈরির কাজ করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির। যে কারণে কোনো চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ইভটিজিং, মাদক, বা নারী কেলেংকারীর ঘটনায় ছাত্রশিবিরের কোনো নেতাকর্মীর নাম আসে না। কারণ জামায়াত ও শিবির মডেল সোনার মানুষ তৈরি করে।
দলের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ সকল নেতাকর্মীর মুক্তি দাবি করে ডা. তাহের বলেন, আমাদের অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে রাখছেন। অবিলম্বে সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। তা না হলে জামায়াত নিজেরাই নেতাদেরকে মুক্ত করবে এবং পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হবে।
মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমীর নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় সমাবেশে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক এডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। লিখিত বক্তব্যে কেন্দ্রীয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয় খুলে দেয়া, মিছিল মিটিংয়ের ওপর বিধি নিষেধ তুলে দেয়া, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, বন্ধ গণমাধ্যম খুলে দেয়াসহ দশ দফা দাবি জানানো হয়।
সভাপতির বক্তব্যে নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, আমরা দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সভা-সমাবেশ করতে পারিনি। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নতশিরে মাথানত করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম শেষে, দশ বছর পরে বহু শহীদ, জেল-জুলুমের পরে তাদের কথা বলার অধিকার, সমাবেশ করার অধিকার, মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় সমাবেশ করার সুযোগ পেয়েছি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, যারা আমাদের সমাবেশের অনুমতি নিয়ে টালবাহানা করছে তারা জমায়াতের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। বরং তাদেরই ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করবো। বিশৃঙ্খলা জামায়াতের ঐতিহ্যে নেই। এই সরকার জনগণকে ভয় পেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে গেছে। তারা মুখে বলে গণতন্ত্র আর ক্ষমতায় গেলে বাকশাল কায়েম করে মুখ চেপে ধরে। আজকে সরকারের সময় শেষ। কয়েকমাস বাকি আছে। অবিলম্বে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। কারণ আপনাদের অধীনে কোনোদিন সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ যত সুন্দর কথা বলুক তাদের বিশ্বাস করা যায় না। জামায়াতে ইসলামী আবিষ্কৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা সঠিক। অতীতে ৩টি জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের অধীনে আর নির্বাচন নয়।
মাওলানা আবদুল হালিম বলেন, যারা আমাদের নিষিদ্ধ ও অবৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে অভিহিত করেছেন তারাই আজকে আমাদের সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। তাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। কই আমাদের সমাবেশ থেকে তো একটি ঢিল ছুঁড়তে দেখা যায়নি। তাহলে জামায়াতের বিরুদ্ধে সংঘাতের অভিযোগ কেনো?
মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল সমাবেশ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রথমে অনুমতি দেয়নি। পরে তারা নিবন্ধন না থাকার অজুহাত দিতে শুরু করে। জামায়াত তো ২০০৮ সালে নিবন্ধন পেয়েছে। পরে নিবন্ধন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এর আগে কারও বলার নেই জামায়াত অনিবন্ধিত দল। নির্বাচন কমিশনকে জবাব দিতে হবে তারা কোন আইনে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছেন? অবিলম্বে তাদেরকে ওয়েবসাইট সংশোধন করতে হবে।
সমাবেশে ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে অন্যায়ভাবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। দশ বছর পর আজকে আমাদের সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমরা অন্য রাজনৈতিক দলের মতো সভা-সমাবেশ করতে চাই। জামায়াতের কার্যালয় খুলে দিতে হবে। নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে দাবি আদায় করা হবে।
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্দুর রহমান মূসা, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের নায়েবে আমীর এডভোকেট ড. হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরীর উত্তরের নায়েবে আমীর ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা, সহ. সেক্রেটারি মাওলানা মাহফুজুর রহমান, নাজিম উদ্দীন মোল্লা, ডা. ফখরুদ্দিন মানিক, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলওয়ার হোসাইন, কামাল হোসাইন, ড. আব্দুল মান্নান, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সেক্রেটারি আতিকুর রহমান, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
ওদিকে সমাবেশ ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা ছিল পুরো এলাকায়। পুলিশের নজরদারি পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সমাবেশের আশপাশের এলাকা নজরদারি করেন। নেতাকর্মীদের চাপে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন এর সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে দলীয় নেতাকর্মী ও পুলিশের সহযোগিতায় সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করা হয়।