ডলার সংকট কাটাতে এলসিতে কড়াকড়ি আরোপের কারণে আমদানি ব্যয় সামান্য কমলেও বাণিজ্য ঘাটতি সেই হারে কমছে না। অর্থাৎ এলসি’র হার কমলেও আমদানি দায় পরিশোধ কমেনি। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তি থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ নিম্নগতি চলছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় ডলার ব্যয় বেশি হচ্ছে। এতে করে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ খুব বেশি কমছে না। আবার জরুরি পণ্য আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করায় টান পড়েছে রির্জাভেও। এদিকে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মূলত আগে নেয়া ঋণ পরিশোধের তুলনায় নতুন ঋণ কম আসছে। এতে সামগ্রিক লেনেদেনের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ৫ হাজার ৮৭৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে।
এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৩০৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারের পণ্য। এতে করে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি ১০ লাখ (১৫.৭৩ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি ১ ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) এর পরিমাণ ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের ঊর্ধ্বগতি ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স ও বিদেশি বিনিয়োগ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ। চলমান পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতির জন্য রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও নতুন ঋণ পাওয়ার ওপর জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিভিন্ন শর্ত দেয়া হয়েছে। এতে করে এলসি’র হার কমলেও আমদানি দায় পরিশোধ কমেনি। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় কমার পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহেও নিম্নগতি চলছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হচ্ছে। এতে করে বাড়ছে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। একই সময় সামগ্রিক বৈদেশিক লেনদেনেরও বিশাল ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
সূত্র মতে বিলাস পণ্যের আমদানিতে লাগাম টেনে ধরতে জরুরি পণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্য আমদানি কমানোর উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১১ই এপ্রিল এক সার্কুলারের মাধ্যমে শিশুখাদ্য, জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্প এবং কৃষি খাতসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানি ছাড়া অন্য সকল পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র স্থাপনের (এলসি) নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এরপরও আমদানি কমছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, আমদানি ব্যয় কমার পরও গত এক মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। এ সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে ১ হাজার ৫৭৩ কোটি ডলার। এক মাস আগে মার্চ পর্যন্ত এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৬২ কোটি ডলার। আর গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৭৬৯ কোটি ডলার।
চলতি হিসাবে ঘাটতিও গত এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে। এ সময়ে চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৩৭৭ কোটি ২০ লাখ ডলার। আগের মাস মার্চে যা ছিল ৩৬৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ফলে গত এক মাসের ব্যবধানে চলতি হিসাবে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে প্রথম ১০ মাসে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল রেকর্ড ১ হাজার ৫৪৮ কোটি ডলার। সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। তবে ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়। চলতি হিসাবের পাশাপাশি গত এক মাসে আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি বেড়েছে বাংলাদেশের। এ সময়ে ২১৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আগের মাস মার্চ পর্যন্ত এই হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২০৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ফলে গত এক মাসে ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ১২ কোটি ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হিসাবে ৮৬৫ কোটি ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ কমেছে প্রায় ২৬.৩৪ শতাংশ। এ সময়ে এ ধরনের ঋণ পাওয়া গেছে ৫৫৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫২ কোটি ডলার। একই সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে ১৩৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭.৪০ শতাংশ বেশি। একই সময়ে স্বল্পমেয়াদি কোনো ঋণই পায়নি বাংলাদেশ। উল্টো ১৭২ কোটি ডলারের মতো ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে।
একই সময়ে বৈদেশিক ঋণ সহায়তাও কমেছে। গত অর্থবছরের ১০ মাসে যেখানে ৬২২ কোটি ডলারের সহায়তা এসেছিল, সেখানে এবার এসেছে ৪১৪ কোটি ডলার। এ সময়ে নিট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ১২ শতাংশ। প্রথম ১০ মাসে ১৪৯ কোটি ডলারের নিট এফডিআই এসেছে। একই সময়ে আশঙ্কাজনক হারে কমেছে শেয়ারবাজারে বিদেশিদের পোর্টফলিও বিনিয়োগ। এ সময়ে নিট পোর্টফলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ধারায় রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে ২৫৪ কোটি ডলারের স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধ হয়েছে।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয়ে একের পর এক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তারপরও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অব্যাহত গতিতে কমছে। বৈদেশিক ঋণ ও এলসি’র দেনা পরিশোধ করতে গেলেই রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। চলতি জুনের এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার। রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৯.৭৭ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগেও ছিল ৪১.৭৪ বিলিয়ন ডলার। ফলে গত এক বছরে রিজার্ভের পরিমাণ কমেছে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। এদিকে এলসি খোলাও কমিয়ে দিয়েছে। ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল, গ্যাস আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিংয়ের মাত্রা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমদানিতে এখনো যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে; রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে যদি ভালো প্রবৃদ্ধি না হয়, তাহলে ব্যালেন্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে। তবে এটা দ্রুত ওভারকাম করতে হলে অবশ্যই রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন ঋণও পেতে হবে।