সার্বিকভাবে আমদানির নতুন এলসি খোলা কমলেও বকেয়া এলসি দায় পরিশোধের চাপ এখন বেড়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার খরচ বেড়েছে।
এদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে প্রত্যাশিত হারে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ছে না। ফলে ডলারের চাহিদা বাড়ায় টাকার মান কমে যাচ্ছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের চাপে লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে যাচ্ছে। এতে রিজার্ভ অব্যাহত গতিতে কমে যাচ্ছে। এ অবস্থায় টাকার মানে ও বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশীলতা রাখতে রিজার্ভ বাড়ানো অপরিহার্য।
কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়িয়ে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে তাপপ্রবাহ বয়ে যাওয়া ও অন্যান্য প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর কিছুটা নেতিবাচক প্রভাবও অর্থনীতিতে পড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে পড়ায় সার্বিকভাবে নিট বৈদেশিক সম্পদে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় প্রত্যাশিত হারে না বাড়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭২ শতাংশই আসে এ দুটি খাত থেকে।
বাকি ২৮ শতাংশ আসে অন্যান্য খাত থেকে। অন্যান্য খাতের মধ্যে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিলে কমেছে ১৯ শতাংশ। বৈদেশিক অনুদান কমেছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় ১০ শতাংশ বাড়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।
জুলাই-মে মাসে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনও ৩ শতাংশ কম প্রবৃদ্ধি রয়েছে। রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৪ শতাংশ। জুলাই-মে সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ কম রয়েছে। অর্থাৎ সব খাতেই বৈদেশিক মুদ্রার আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হচ্ছে।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে আমদানিতে। চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ শতাংশ। জুলাই-এপ্রিলে আমদানি কমেছে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার বেশি কমেছে। ডলার সংকটে আমদানি বেশিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করায় শিল্পসহ ভোগ্যপণ্য খাতে সংকট দেখা দিয়েছে।
চলতি অর্থবছরের জুনের শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ৬৫০ কোটি ডলারের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ৭ জুন রিজার্ভ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৯৭৮ কোটি ডলারে। নিট হিসাবে রিজার্ভ আরও কম। বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমায় এবং খরচ বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। বরং রিজার্ভ থেকে চলতি ব্যয় মেটাতে ডলার বিক্রি করায় রিজার্ভ কমে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি অব্যাহত রাখায় ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে টাকার অবমূল্যায়নের গতিও কমানো গেছে।
ডলারের চাহিদা মেটাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে ১ হাজার ৩১১ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে বিক্রি করেছিল ৭৬৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ৫৪৮ কোটি ডলার বেশি বিক্রি করেছে।
কিন্তু এর বিপরীতে টাকার মান কিছুটা ধরে রাখা সম্ভব হলেও রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এ মুহূর্তে রিজার্ভ বাড়িয়ে একটি স্বস্তিদায়ক পরিস্থিতে নিয়ে যাওয়াটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু বৈশ্বিক ও দেশীয় বিদ্যমান বাস্তবতায় এটি এখন বড় চ্যালেঞ্জিং।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের বাণিজ্য ঘাটতি ২ হাজার ৯০ কোটি ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত ঘাটতি হয়েছে ১ হাজার ৩১০ কোটি ডলার। তবে ঘাটতি আগের চেয়ে কমেছে।
গত অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি হয়েছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি ৬৮২ কোটি ডলারে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিলে ঘাটতি ৩৭৭ কোটি ডলার হয়েছে। গত অর্থবছরের তুলনায় অনেকটা কমেছে। তবে আর্থিক হিসাবে গত অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল। চলতি অর্থবছরেও এ হিসাবে ২৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত রাখার লক্ষ্যছিল।
মার্চ পর্যন্ত এ হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ২২২ কোটি ডলার। এতে ঘাটতি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে। এ হিসাবে ঘাটতি কমিয়ে উদ্বৃত্ত করার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার দায় কমাতে হবে, বাড়াতে হবে আয়। বৈদেশিক ঋণের কারণে দায় কমানো যাচ্ছে না।
উলটো এখন আগে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সেগুলোর মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়তে পারে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সার্বিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ সাড়ে ১৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ১১ দশমিক ০৭ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, এটি ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব। বাকি ৫ শতাংশ ঘাটতি থেকে যাবে। ঋণ প্রবাহ কমার কারণে সরকারি বেসরকারি খাতে টাকার প্রবাহ কমবে। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির গতিও বাধাগ্রস্ত হবে।
চলতি অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এটি বেড়ে ২৭ শতাংশ হতে পারে। বছর শেষে ঘাটতি থাকবে ৭ শতাংশের বেশি।
চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ১৪ দশমিক ১ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল। জুলাই-এপ্রিলে বেড়েছে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকের চেয়ে সামান্য বেশি বেড়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমায় সার্বিকভাবে এ খাতের কর্মকাণ্ডও কমেছে। অথচ মোট কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই বেসরকারি খাতে হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় আক্রান্ত হয়েছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিও। এতে ডলারের ওপর চাপ বাড়ায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিতেও চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের বড় ঘাটতি এবং দেশীয় বাজারে জ্বালানি ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কারণে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতি বাধাগ্রস্ত করছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার গতিবেগ। ফলে দেশের উৎপাদন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
দেশের মোট জিডিপিতে শিল্প ও সেবা খাতের অবদান প্রায় ৮৮ শতাংশ। বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য খাতের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
এর আগে তারা সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। এখন সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রবৃদ্ধি কম হচ্ছে। গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। এদিকে বিশ্বব্যাংক মনে করছে প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ২ শতাংশের মধ্যে সীমিত থাকবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মন্দায় তিনটি খাতে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এতে প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এগুলো হচ্ছে-শিল্প, পরিষেবা এবং কৃষি। শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ। সরকারি ব্যয় কমে যাওয়া এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে প্রবৃদ্ধির ওপর ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
একই সঙ্গে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানির প্রবৃদ্ধি হ্রাস এবং প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধির গতিকে ব্যাহত করেছে।
এদিকে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা ধরনের নীতিসহায়তা বাড়ানো হয়েছে। এতে উৎপাদনশীল খাতে অর্থের প্রবাহ বেড়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধির চাকা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে রপ্তানির বিস্তার ও রপ্তানি বাড়ানো দুই খাতেই বাড়তে পারে ঝুঁকির মাত্রা। প্রতিবেদনে আশা করা হয়, বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা কাটতে শুরু করায় আগামীতে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়তে পারে।
এছাড়া বিনিময় হারে বাড়তি সুবিধা, আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ সম্প্রসারিত হওয়ায় রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।