কথা ছিল এ বছর জুন-জুলাইয়ের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রে পানি থাকবে অন্তত ১০ ফুট। এই নদ দিয়ে ভারী নৌযান চলবে ঢাকা পর্যন্ত। কিন্তু এখন কোনো কোনো স্থানে হাঁটুপানি। নদে প্রাণ ফেরার স্বপ্ন দেখা হচ্ছিল পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা খরচের খনন প্রকল্প ঘিরে। তবে ফিকে হয়ে আসছে সেই স্বপ্ন।
ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্পের কাজ আগামী বছর শেষ হওয়ার কথা। চার বছর আগে এই কাজ শুরু হলেও অগ্রগতি সামান্যই। ইতোমধ্যে খননে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। খনন কাজ করার পর ময়মনসিংহ এলাকায় বিভিন্ন অংশে নতুন চর জাগছে। এর মূল কারণ যমুনা নদীর সঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের উৎস মুখ খনন করতে না পারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় নদের গতিপথ বিবেচনায় পরিকল্পনা না করে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী জমির বিষয় বিবেচনা করার কারণে গাইবান্ধার উৎস মুখ এলাকায় বাধা পেতে হচ্ছে। নদের উৎসমুখ ফুলছড়ি উপজেলার সন্ন্যাসীরচরে এখন মানুষের বসতি। তাই সংকট কাটছে না। সময়মতো কাজ না করায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও অন্তত তিন বছর বাড়াতে হবে। এতে খরচ অনেক বাড়তে পারে।
ব্রহ্মপুত্র বাঁচানোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুই হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২২৭ কিলোমিটার খনন কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এই কাজ বাস্তবায়ন করছে। খননে শুরু থেকে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। খননের পর যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুমে ৩০০ ফুট প্রশস্ত ও ১০ ফুট গভীর পানি থাকবে– এমনটি কথা ছিল। ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য উন্নয়নে ড্রেজিং’ শীর্ষক প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের প্রথম দুই বছর ড্রেজিং এবং পরবর্তী তিন বছর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করার কথা। প্রায় চার বছর ধরে খনন চলে এলেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না, বরং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি খরা।
সিএস রেকর্ড অনুযায়ী যমুনার সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থল গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় সন্ন্যাসীরচর এলাকায়। বর্তমানে সন্ন্যাসীরচর এলাকা দিয়ে ব্রহ্মপুত্রে কোনো পানি প্রবেশ করে না। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা এলাকা দিয়ে ভারতের ছোট ছোট নদী থেকে অল্প পানি ব্রহ্মপুত্র নদে আসে বলে জানিয়েছেন খনন প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের ড্রেজিং বিশেষজ্ঞ পঙ্কজ মৈত্র।
অনেক মানুষ ভিটে হারানোর শঙ্কা থেকে নদ খননে বাধা দিচ্ছে। এই খনন পরিকল্পনা নিয়ে রয়েছে সন্ন্যাসীরচরসহ বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের নানা অভিযোগ। ব্রহ্মপুত্রে যে দিক দিয়ে পানি আসছে সে দিকেই খননের দাবি তাদের। এ প্রসঙ্গে পঙ্কজ মৈত্র বলেন, নদের সংযোগ যেখানে ছিল সেখানে ভরে গেছে। যমুনার সঙ্গে সংযোগ করলে নদ খননের উদ্দেশ্য সফল হবে। উৎসমুখ কাটার পর কী হতে পারে সে বিষয়গুলো মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই করার শুরুতেই উৎস মুখে মানুষের সঙ্গে কথা বলা হয়। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন মতাদর্শের লোক থাকায় বাধা দিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে তাদের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের একটি বিশেষজ্ঞ টিম দুই বছর ধরে কাজ করছে। তারা বলছে নদী যেদিকে প্রবাহিত হয় তা বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে।
খননের মাটি নদের পাড়েই
ব্রহ্মপুত্র খনন করে মাটি ফেলা হচ্ছে পাশেই। এতে অনেক জায়গায় স্তূপ করে রাখা বালু ফের মিশছে নদে। এছাড়া ময়মনসিংহ নগরীর কাচারিঘাট এলাকায় নদের মাঝখানে চলে বালুর ব্যবসা। খনন করে মাটি ফেলার জন্য বিআইডব্লিউটিএকে পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছে না জেলা প্রশাসন। তাই মাটি মিশছে নদে। আবার অনেক স্থানে প্রভাবশালীরা স্তূপ করে রাখা মাটি অবাধে বিক্রি করছে।
বিআইডব্লিউটিএ’র ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহসিন মিয়া বলেন, মাটি ফেলার জন্য জেলা প্রশাসন জায়গার ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা। খাসজমি না পাওয়ায় তাদের জায়গা দিতে সমস্যা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, নদের পাড়ে পর্যাপ্ত খাসজমি নেই। কৃষি জমিতে মাটি ফেলা হলে কৃষকের ক্ষতি হয়। প্রকল্পের মাটি ফেলার জন্য জমি ভাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বয় করে সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করা হচ্ছে।
খনন নিয়ে ক্ষুব্ধ নাগরিকরা
নদের বিরাট অংশজুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। কোথাও হাঁটুসমান পানি। হেঁটেই পারাপার হচ্ছেন অনেকে। অনেক জায়গায় পানির প্রবাহ নালার মতো। ময়মনসিংহ নগরীর খাগডহর, জেলখানার ঘাট, পুলিশ লাইন, জয়নুল আবেদিন উদ্যান, কাচারিঘাট, জুবলিঘাট, থানাঘাট, কালীবাড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় এমন মরণদশা। নদের অভ্যন্তরে গাড়ি ধোয়ানো হয় এখন। খনন নিয়ে শুরু থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন, জনউদ্যোগ, ময়মনসিংহ, জেলা নাগরিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। নদ খনন অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় এবং ত্রুটিপূর্ণভাবে হচ্ছে দাবি করে সংগঠনগুলো কর্মসূচি পালন করে আসছে। গতকাল শুক্রবার নাগরিক আন্দোলন কাচারিঘাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে ‘ব্রহ্মপুত্র রক্ষায় নাগরিক চিৎকার’ কর্মসূচি পালন করে।
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নুরুল আমিন কালাম জানান, ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ খনন না করা পর্যন্ত এর সুফল মিলবে না। খননের নামে যা চলছে তা মেনে নেওয়া যায় না। পরিকল্পিতভাবে খনন করে নদের প্রাণ ফেরানোর দাবি জানান তিনি। জনউদ্যোগ ময়মনসিংহের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু বলেন, নদ খননের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের প্রক্রিয়া চলছে। ২০২২ সালে এক বৈঠকে খনন কাজের তৎকালীন প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কারী প্রকৌশলী খন্দকার রাকিবুল ইসলাম বলেছিলেন, ২০২৩ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে এই নদ দিয়ে বার্জ চলবে ঢাকা পর্যন্ত। খননের পর শুকনো মৌসুমে সব জায়গায় ১০ ফুট গভীর পানি থাকবে। কিন্তু এখন অনেক স্থানে ১০ ইঞ্চি পানিও নাই। এর কৈফিয়ত জনগণকে দিতে হবে।
ভিটে হারাবার শঙ্কায় খনন কাজে বাধা
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ প্রতিনিধি রাজ্জাক মিকা জানান, ব্রহ্মপুত্র খনন বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে জেগে ওঠা চরে বসতি গড়া মানুষ ভিটে হারাবার শঙ্কায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো মূল্যে খনন ঠেকাতে একাট্টা তারা। সিএস রেকর্ড অনুযায়ী যে এলাকায় নদী সেখানে বর্তমানে মানুষের বসতি। বিভিন্ন সময়ে সেখানে জমি ব্যক্তির নামে রেকর্ডভুক্ত হয়েছে। জমি বেঁচাকেনাও হচ্ছে। স্থানীয়রা বলছেন, ১৯৬৮ সালের দিকে যমুনায় বিলীন হয় ফুলছড়ি উপজেলার সন্ন্যাসীরচর। ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষেরা বসতি স্থাপন করে এরেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের হরিচন্ডি, পাগলার চরসহ বিভিন্ন গ্রামে। ১৯৭৫ সালের দিকে আবার চর জেগে ওঠে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকজন আবার সেখানে বসতি স্থাপন করে। স্থানীয়দের দাবি, বিআইডব্লিউটিএর ম্যাপ অনুযায়ী যমুনায় ব্রহ্মপুত্রের উৎস মুখ করা হলে সন্ন্যাসীরচর, হরিচন্ডিসহ পুরো এলাকা আবারও পড়বে ভয়াবহ ভাঙনের মুখে। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের মন্ডলবাজার, পোল্যাকান্দি নামাপাড়াসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সন্ন্যাসীরচরের আইয়ুর আলী জানান, নদ খনন নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেনি কেউ। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে সন্ন্যাসীরচর-হরিচন্ডির মানুষেরা স্থায়ী বসতভিটা ও আবাদি জমি পেয়েছে। খনন করা হলে বিলীন হয়ে যাবে হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নের ভিটা। এ কারণে এলাকাবাসী সংঘবদ্ধ। দেওয়ানগঞ্জের কাজলাপাড়া গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই জানি ব্রহ্মপুত্রের উৎসমুখ কুড়িগ্রাম জেলার কোনো এক উপজেলায়। ভারত থেকে নদটি কুড়িগ্রামে এসে বাংলাদেশে পড়েছে। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ কোন সূত্রে যমুনাকে ব্রহ্মপুত্রের উৎস মুখ বলছে তা বোধগম্য নয়। যমুনার পানি মূল ব্রহ্মপুত্রে প্রবেশ করানো হলে নদ হবে প্রমত্তা। ভাঙনের কবলে পড়বে দেওয়ানগঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চল।’
বিআইডব্লিউটিএ’র জামালপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী সমীর পাল সমকালকে বলেন, উৎস মুখে খনন করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে। সমস্যাটি সমাধানের জন্য জামালপুরের জেলা প্রশাসক, গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক ও রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা যা বলেন
বিআইডব্লিউটিএ’র ময়মনসিংহের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মহসিন মিয়া সমকালকে বলেন, ‘খনন কাজে কোনো অনিয়ম হচ্ছে না। খননের পরও বারবার চর জেগে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের উৎস মুখে খননের কাজ শুরু করা যায়নি।
ময়মনসিংহের কাচারিঘাট এলাকায় ২০১৯ সালে শুরুর দিকে খনন করা হয়। কিন্তু বর্ষায় নদের উৎস মুখের এলাকা থেকে বালু এসে চর জেগেছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে জেগে ওঠা চর নতুন করে খনন করার। কিন্তু খনন করে মাটি ফেলার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইডব্লিউটিএ তদারকি করে যেভাবে বলে আমরা সেভাবেই কাজ করি। তাদের বারবার চিঠি দেওয়া হচ্ছে, তারা যেন পরিদর্শন করে একটি সিদ্ধান্ত দেয় কীভাবে ভালো ফল পাওয়া যাবে। বারবার ভরাট হয়ে গেলে তো সমস্যা।’ তিনি আরও বলেন, প্রকল্পে অর্থ ছাড় হচ্ছে খুব কম। এ কারণে বাধগ্রস্ত হচ্ছে কাজ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যথাসময়ে কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। তাই খনন প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়তে পারে।
বিআইডব্লিউটিএ’র প্রধান প্রকৌশলী খন্দকার রাকিবুল ইসলাম বলেন, উৎস মুখে দুইবার খনন করতে গিয়ে ফিরে আসতে হয়। আমরা যদি মুখই না কাটতে পারি তবে এটির সুফল হবে না। সেখানে ২৭ কিলোমিটার এলাকায় বসতি এবং নদ সরে গেছে অন্তত ১০-১২ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ওই অংশ কাটতেই হবে। বিষয়টি নিয়ে বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়ে সভা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, উৎস মুখ না খুলতে পারলে কোনো লাভ হবে না।
সম্প্রতি ময়মনসিংহে একটি অনুষ্ঠানে আসা নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি কোম্পানির সঙ্গে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তারা খতিয়ে দেখছে কীভাবে লকটা খুলে দেওয়া যায়।’