বাজারে নিত্যপণ্যের দাম এখন আকাশছোঁয়া। প্রতিদিনই কোনো না কোনো পণ্যের দাম
বাড়ছে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের সেবার দামও বাড়ছে লাগামহীন গতিতে।
ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় খরচের খাতা বেড়েই যাচ্ছে।
Advertisement
খরচ বাড়লে আয়ও বাড়াতে হয়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ভোক্তার
আয় বাড়ছে না। বিশেষ করে স্বল্প-আয়ের মানুষের আয় বাড়ার পরিবর্তে আরও কমেছে।
তাদের আয়ের চেয়ে খরচ বেড়েছে বেশি। ফলে জীবনযাপনে চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
এতেও জীবন চালানো দায় হয়ে পড়েছে। ফলে অনেকে আগের সঞ্চয় ভেঙে সংসারের খরচ
মেটাচ্ছেন। নতুন সঞ্চয় করতে পারছেন না। যে কারণে জাতীয় সঞ্চয়ে ভাটা পড়েছে। এর
নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সার্বিক অর্থনীতিতে। অন্যদিকে যাদের সঞ্চয় নেই, তারা ঋণ
করে সংসার চালাচ্ছেন।
সরকারের বাণিজ্য সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) হিসাবে গত এক
বছরের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ২ থেকে আড়াই, মাঝারি মানের চাল ৫, আটা ১৩, আলু
৬২ এবং পেঁয়াজের দাম ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে চিনির ৫৮ এবং
লবণের দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে। প্রোটিনজাতীয় পণ্যের মধ্যে রুই ৩৩, বয়লার মুরগি ৩১,
দেশি মুরগি ৩৪, গরুর মাংস ১৫ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ। বেসরকারি হিসাবে
এসব পণ্যের দাম আরও বেশি বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি
হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা, যা গত বছর একই সময় ছিল ৪৬ টাকা। খোলা আটা কেজিপ্রতি বিক্রি
হচ্ছে ৫৫ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৫০ টাকা। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত আটা বিক্রি
হচ্ছে ৬৫ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৫২ টাকা। আলুর কেজি ৪০, যা গত বছর ছিল ২২-
২৫ টাকা।
দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা, যা আগে ৪০ টাকা ছিল। দেশি আদার কেজি
৩৫০, যা গত বছর একই সময় ছিল ১২০ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ থেকে বেড়ে
৮০০ টাকা হয়েছে। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকা, আগে ছিল ১৫০
টাকা। গত বছর প্রতি কেজি চিনি ৮৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বছরের ব্যবধানে ৩৬ টাকা কেজি খাবারের প্যাকেটজাত লবণ ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৮-৫০ টাকা, যা গত বছর একই সময় ৪০ টাকা
ছিল। মিল্ক ভিটার তরল দুধ আগে ছিল ৮০ টাকা লিটার। এখন তা বেড়ে ৯০ টাকা হয়েছে।
পাশাপাশি সব ধরনের শিল্পপণ্যের দামও বেড়েছে। বিস্কুটের প্যাকেট আগে যেগুলো ১০
টাকা ছিল, তা এখন ১৫ টাকা। ৬৮ টাকা দামের চানাচুরের প্যাকেট এখন ৮০ টাকা। ৩০
টাকা দামের সাবান ৫৫ টাকা।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা মো. আক্তার আলী বলেন, আমি একটি বেসরকারি
অ্যাড ফার্মে কাজ করে মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পাই। মা-বাবা, স্ত্রী ও এক মেয়ে
নিয়ে আমার সংসার। সেখান আমিসহ তাদের খাবার জোগাড় করতে মাসে ৫০ কেজির এক
বস্তা চাল ৩ হাজার, ৪ লিটার তেল ৮০০, বাসা ভাড়া ১০ হাজার; সবজি, মাছ, ব্রয়লার
মুরগিসহ তরকারি রান্নার উপকরণ কিনতে ৭ হাজার, গ্যাস সিলিন্ডার ১৫০০, সাবান-
ডিটারজেন্ট ও শ্যাম্পু ৫০০, মুদি বাজার আরও ২ হাজার, বিদ্যুৎ বিল ৮০০ এবং মোবাইল
টকটাইমে খরচ হয় ৫০০ টাকা।
মা-বাবার হাতে ৫ হাজার টাকা দিলে সব মিলিয়ে খরচ হয় ৩১ হাজার ১০০ টাকা। এছাড়া
মেয়ের পড়াশোনা, সবার চিকিৎসা, যাতায়াত খরচ তো আছেই। ফলে নিত্যপণ্যের যেভাবে
দাম বাড়ছে আর যে টাকা আয় করছি, তা দিয়ে এখন আমি সব খরচ বহন করতে পারছি না।
একটু একটু করে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। তবে আগে একটু সবইকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেও
এখন তা পারছি না। বেঁচে থাকতে প্রয়োজনীয় খাবার রান্না ছাড়া কোনো ধরনের ভালো-মন্দ
খাবার জুটছে না। পরিস্থিতি এমন-জীবনযাপন করতেই এখন খুব কষ্ট হচ্ছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন,
প্রতিবছর প্রতিটি পণ্যের দাম অসহনীয়ভাবে বাড়ছে। কিন্তু সেভাবে ক্রেতার আয় বাড়ছে
না। আয় না বাড়ায় ক্রেতার বাড়তি দরে পণ্য কেনা এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে। অনেক ক্রেতা অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্যকিছু কেনা বাদ দিয়েছেন।
অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাবারের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে শরীরে
পুষ্টি ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে। তিনি আরও জানান, পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি ঠিক রাখতে
সরকার যথেষ্টভাবে চেষ্টা করছে। কারণ, বিশ্বমণ্ডলে এখন পণ্যের মূল্য পরিস্থিতি
অনেক চড়া। তবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সুযোগ নিচ্ছে।
তারা সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়তি রেখে ভোক্তার পকেট কাটছে। অনেক সময় একই
সিন্ডিকেট চক্র বারবার ভোক্তার পকেট কাটলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। তাই
এদিকে নজর দিতে হবে।
সূত্র জানায়, সব ধরনের সেবার দামও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের
ব্যবধানে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দুই দফায়
বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ।
এর প্রভাবে সব ধরনের শিল্পপণ্যের দাম বেড়েছে। এদিকে ক্রেতার আয় না বাড়ায় চাহিদা
অনুযায়ী পণ্য কিনতে পারছেন না ভোক্তা। ফলে উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকছে। এতে
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হয়ে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। সার্বিকভাবে এর নেতিবাচক
প্রভাব সব খাতেই পড়ছে।
কৃষি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত সব ধরনের উপকরণের দাম বেড়েছে। সারের দাম গত
বছরের আগস্ট থেকে গত এপ্রিল পর্যন্ত দুই দফায় বেড়েছে ৭৮ শতাংশের বেশি। ওই
সময়ের ব্যবধানে ১৪ টাকা ইউরিয়ার কেজি এখন ২৫ টাকা হয়েছে।
কৃষিতে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ও বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। ফলে সেচ খরচ বেড়েছে। ডলারের
দাম বাড়ায় কীটনাশক, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ আমদানির খরচ বেড়েছে। ফলে
এগুলোর দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কৃষি খাতে বেড়েছে উৎপাদন খরচ।
যার প্রভাবে বেড়েছে পণ্যের দামেও। গত বছরের আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম এক
ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর প্রভাবে পণ্য পরিবহণ, গণপরিবহণের
ভাড়া বেড়েছে। এতে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে।
https://www.jugantor.com/todays-paper/first-