নিত্যপণ্যের অসহনীয় দাম, ঘনঘন লোডশেডিং, পানি-গ্যাস ও জ্বালানির সংকটে মানুষের
জীবন এখন বড় দুঃসময়ের মুখোমুখি। জীবন চালানোই যেন দায় হয়ে পড়েছে।
Advertisement
নিত্যপণ্য ও সেবার অগ্নিমূল্যে ঘর থেকে বের হলেই ভোক্তার পকেট খালি হতে থাকে।
কিন্তু পকেট ভরার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তেমনই শান্তি নেই ঘরেও। লোডশেডিংয়ের
যন্ত্রণায় প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ঘরে থাকাও দায়।
পানির জন্য তো চলছে একধরনের হাহাকার। রান্নার জন্য গ্যাস সংকট এবং এর
অগ্নিমূল্য তো আছেই। অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় লোডশেডিংয়ের সময় নিজস্ব জেনারেটরও
চালানোও যাচ্ছে না। কারণ, চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল মিলছে না।
মিললেও দাম বেশি। গ্রামের অবস্থা তো আরও নাজুক। সবমিলিয়ে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের
মানুষ প্রকৃত অর্থেই কষ্টেসৃষ্টে জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে শিল্প ও ব্যবসা-
বাণিজ্যেও এখন দুঃসময়।
কারণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে এসবের চাকা ঘুরছে না ঠিকমতো। এতে ব্যাহত হচ্ছে
উৎপাদনের স্বাভাবিক গতি। শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার আর্থিক সুবিধায় টান
পড়েছে। সার এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে কৃষি খাতের উৎপাদন খরচও
বেড়েছে।
এর প্রভাব পড়েছে পণ্যের দামে। তবে সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই মূলত পণ্যে দাম
অসহনীয় হয়ে পড়েছে। পরিকল্পিতভাবে পণ্যের দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে চক্রটি। এসব
নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেই দুঃসংবাদ দিয়েছে ডলারের সংকট।
চাহিদা অনুযায়ী ডলার না থাকায় এর দাম বাড়ছে। বিপরীতে টাকার মান কমছে। একসঙ্গে
পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মে পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির
হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
তিন মাস ধরে এ হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এতে মানুষের খরচ বাড়লেও আয় বাড়ানোর
পদক্ষেপ নেই। মেতে মানুষের আয় বেড়েছে গড়ে ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ
মূল্যস্ফীতির চেয়ে আয় কম বেড়েছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। খরচের চেয়ে আয় কম হওয়ায়
মানুষ এখন রীতিমতো অসহায়।
জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও বিশিষ্ট
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নগরের মানুষ একবেলা না খেয়ে থাকতে
পারে; কিন্তু পানি-বিদ্যুৎ ছাড়া কি থাকা যায়?
এখন থাকতে হচ্ছে। কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জোগান দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত
জ্বালানি তেল, কয়লা ও গ্যাস নেই। এ কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে গেছে। ফলে মানুষের
ভোগান্তি বেড়েছে। এ খাতের জন্য জ্বালানি তেল, কয়লা ও গ্যাস আমদানি করা যাচ্ছে না।
কারণ, ডলার নেই। মূলত ডলারের কারণেই অর্থনীতিতে এত সংকট। এ সংকট এখন
মানুষের জীবনযাত্রাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। আগে ডলার বা রিজার্ভ নিয়ে
সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো আলোচনাই হতো না।
এখন তারাও এসব বিষয় আলোচনা করছে। তিনি আরও বলেন, করোনার সময় দেশের এত
রিজার্ভ ছিল। সামান্য ধাক্কায়ই তা এলোমেলো হয়ে গেল। এর পেছনে রয়েছে পরিকল্পনার
ভুল। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এখন অন্তত সঠিক সিদ্ধান্ত
নেওয়ার জন্য দক্ষতার সঙ্গে আলোচনা করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে হবে।
এদিকে মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুৎ ও মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির
হার কমাতে অর্থনৈতিক কৌশলগুলো কাজে লাগানো এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে
জ্বালানি আমদানির ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য ডলারের
সংস্থান করতেও বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নিতে
নির্দেশ দিয়েছেন।
সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশের পর বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কয়লা,
জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে জ্বালানি
আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জরুরি ভিত্তিতে ১০ কোটি ডলার দিচ্ছে।
এর আলোকে ইতোমধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে কয়লা আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে। এ
মাসের শেষদিকে এগুলো দেশে আসবে। তখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আবার
উৎপাদনে যাবে। কিন্তু এরপরও চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জোগান দেওয়া
সম্ভব হবে না।
কেননা চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান নেই। এদিকে ডলার সংকটের কারণে বাজারে এর
দাম বেড়েই যাচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমেছে প্রায় ৩০
শতাংশ। নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য সেবার দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। ফলে
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। এতে ভোক্তা জীবনযাত্রায় চাহিদা কাটছাঁট করতে বাধ্য
হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার আগে থেকেই দেশের অর্থনৈতিক মন্দা বিদ্যমান ছিল। তখনও
বিনিয়োগে ছিল মন্থরগতি। করোনার সময় তা প্রকট আকার ধারণ করে। করোনার ক্ষতি
কাটিয়ে ওঠার আগেই গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে। এতে
আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে দামও লাফিয়ে
বাড়তে থাকে। এর ধাক্কায় বাংলাদেশের অর্থনীতিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার
নেতিবাচক প্রভাব এখনো মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান
হচ্ছে না। ফলে বেকাররা চাকরি পাচ্ছেন না। তাদের আয় বাড়ছে না। যারা কর্মে ছিলেন,
তাদের অনেকের আয় কমে গেছে অর্থনৈতিক মন্দায়।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মন্দায়
বাংলাদেশের কমপক্ষে ৩৭ শতাংশ মানুষের আয় কমে গেছে। কর্ম হারিয়ে নতুন কর্মে যোগ
দিতে না পারা, নিয়মিত বেতনভাতা না পাওয়া, বেতনভাতা কমে যাওয়া, পণ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং
ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মানুষের আয় কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক
মন্দায় বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণ গ্রহণ দ্বিগুণ বেড়েছে। এখন ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণ করে
জীবিকা নির্বাহ করছে।
সূত্র জানায়, এ অবস্থায় সরকার আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী একের পর এক বিভিন্ন
পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। গরিবদের জন্য দেওয়া টিসিবির পণ্য থেকে শুরু করে
তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম কয়েক দফায় বাড়ানো হয়েছে। পানির দামও বাড়ানোর প্রস্তাব
করা হয়েছে। এদিকে চাহিদা অনুযায়ী মানুষ এখন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি পাচ্ছে না। ফলে
জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে সব
খাতেই মানুষের খরচ বেড়েছে। কিন্তু যে হারে খরচ বেড়েছে, সেই হারে আয় বাড়েনি।
অর্থাৎ আয়ের চেয়ে খরচ বেড়েছে বেশি। গড়ে আয়ের চেয়ে খরচ ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ
বেড়েছে। ওই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর গড়ে আয় বেড়েছে ৭
দশমিক ৩২ শতাংশ। এতে মানুষের আয়-ব্যয়ে যে ঘাটতি থাকছে, তা মেটাতে ঋণ করতে
হচ্ছে, ভাঙতে হচ্ছে সঞ্চয়। বিবিএস-এর হিসাবে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে কাপড়
ও জুতা কেনার খাতে খরচ বেড়েছে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। বাসাভাড়া, পানি, গ্যাস-বিদ্যুৎ ও
অন্যান্য জ্বালানি খাতে খরচ বেড়েছে ১১ দশমিক ১৭, গৃহসামগ্রী কেনায় ১১ দশমিক ১২,
চিকিৎসা খাতে ৮ দশমিক ৮৯ এবং বিনোদনে ১২ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বাস্তবে এসব খাতে খরচ আরও বেড়েছে। বিবিএস-এর হিসাবে গণপরিবহণে
ভাড়া বেড়েছে ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। বাস্তবে এ খাতে ভাড়া বেড়েছে ৫০ থেকে শতভাগ।
শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় এ খাতেও খরচ বেড়েছে। ওষুধের দাম দফায় দফায় বাড়ছে।
ফলে চিকিৎসার খরচও বেড়েছে। সবকিছু মিলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে
গেছে। গত অর্থবছরের জুলাই মার্চে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল ১৬৪ কোটি ডলার,
চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১৩৪ কোটি ডলার।
আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগ কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণ
প্রবাহও কমেছে। ফলে বেসরকারি খাতের গতি কমে গেছে। বৈশ্বিক ও দেশীয় মন্দায়
বেসরকারি খাত এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। ফলে এ খাতে কর্মসংস্থানে গতি কমে
গেছে। মোট কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশ হচ্ছে বেসরকারি খাতে। বাকি ৫ শতাংশ সরকারি
খাতে। কর্মসংস্থান কমায় বিশেষ পরিবারের আয় বাড়ানো যাচ্ছে না। এসব কারণে মানুষ
অর্থকষ্টে আছে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার সময়ে অর্থনৈতিক মন্দায়
মানুষের আয় যেভাবে কমেছিল, এখনো সে পর্যায়ে যেতে পারেনি।
https://www.jugantor.com/todays-paper/first-