‘দেখিতে দেখিতে বেগুনের দাম এক আনা হইতে ছয় পয়সা হইয়া গেল। মানুষ বাঁচিবে কী করিয়া?’ প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ রকম একটা কথা আছে তার একটি বইতে। এবার সেই বেগুনের দাম ২০ টাকা থেকে ৮০ টাকা হয়ে গেল। বেঁচে থাকলে এটা শুনে বিভূতি বাবুর ভূষণ-বসনের কী দশা হতো, আল্লাহই জানেন।
কোন্ জিনিস উপরে উঠলে আর নিচে নামে না? অন্তত বাংলাদেশে এর উত্তর-‘পণ্যমূল্য’। বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য একবার বৃদ্ধি পেলে আর কমে না। সারা পৃথিবীতে পণ্যের মূল্য আবার কমে এলেও এই অদ্ভুত দেশে মন্ত্রীরা যদি বলেন, জিনিসের দাম আর বাড়বে না, সাথে সাথে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেয়। মন্ত্রীরা যদি বলেন, ‘জিনিসের দাম ৫০ টাকার বেশি হবে না’। সাথে সাথে দাম অন্তত এর এক টাকা হলেও বেশি হবে। তারা যদি বলেন, ‘আগামী তিন দিন দাম বাড়বে না’। তা হলে তিন দিনের মধ্যেই দাম বাড়া শুরু হয়ে যাবে। বাংলাদেশে রোজার মাস এলে বেশি খুশি হয় অসৎ ব্যবসায়ীরা। অথচ বেশি খুশি হওয়ার কথা পরহেজগার, রোজাদার ও সৎ ব্যবসায়ীদের। নিত্যপণ্যের মূল্য একবার বাড়লে আর কমে না কেন- এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারে না। অথচ পৃথিবীর সব মুসলিম দেশই রোজার মাস এলে জিনিসের দাম কমায়। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশ।
কথায় বলে, ‘আদার বেপারির জাহাজের খবর রেখে লাভ কী’। এখন সেই আদার দাম ঢাকাতেই কমপক্ষে ৩০০ টাকা, ৫০০ টাকায় উঠে যাওয়াও বিচিত্র নয়। আদার অভাবে রাজধানীতে অনেকের চা পর্যন্ত খাওয়া হচ্ছে না। আদার বেপারিদের লাখ লাখ টাকা। অতএব তারা না রাখলে কে রাখবে জাহাজের খবর? একই অবস্থা চিনিরও। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, আগামী কয়েক দিন চিনির দাম বাড়বে না। দেখি, এবার ব্যবসায়ীরা মন্ত্রীর কথা শুনে কি না। মন্ত্রী আরো বললেন, যারা চিনির দাম বাড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দেখা যাক, এখন তিনি কী ব্যবস্থা নেন। তবে তাদের ওপর বেশি ভরসা করা চলে না।
এই দেশের কবি অতীতে একসময় বলেছিলেন, ‘স্বদেশের কুকুর পুঁজি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া’। আর সেই দেশের মানুষ আদা, চিনিসহ সব ক্ষেত্রেই বিদেশের মুখাপেক্ষী। তাই আদার বেপারিদের এখন বিদেশের জাহাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, কারণ স্বদেশী আদা বা চিনির চেয়ে বিদেশী পণ্যের দাম বেশি। আদার ঝাঁজ কমেনি, ঠিক তেমনি চিনির মিষ্টি স্বাদও। কাঁচামরিচের ঝালও কমেনি কিন্তু প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ জ্বালানির দাম দফায় দফায় বাড়ালেও কেউ কিছু বলার উপায় নেই। আমরা দেশী জিনিসের দাম বাড়াতে গিয়েও বিদেশী রেফারেন্স টানার সিদ্ধহস্ত। এ জন্য করোনা মহামারী থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের উদাহরণের অভাব হয় না। বিশ্বের আর কোথাও দাম না বাড়লেও বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে। কারণ ‘খলের ছলের অভাব হয় না’।
ডাবের দাম ৩০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা হলেও কারো কিছু বলার নেই। আর নারকেলের দাম ১০ টাকা থেকে ১৩০-১৫০ টাকায় উঠলেও কারো কিছু বলার উপায় নেই। দিন যত যাচ্ছে, তত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে।
যে আগুন দেখা যায় না, তা হলো, বাজারের অগ্নি। বলা হয়, অগ্নিমূল্যে জনগণ দিশেহারা’। বাজারে গেলে টের পাওয়া যায় জিনিসের দাম কেমন, আকাশচুম্বী মূল্য থামানোর কেউ নেই। করোনা মহামারীর আগে থেকেই এই অবস্থা। এর সাথে কেউ সন্ত্রাসী হামলা, মূল্যস্ফীতি, ডলার সঙ্কট ইত্যাদি কারণ যোগ করে থাকে। কিন্তু সব ঝামেলা এসে পড়ে স্বল্পবিত্ত সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। তারা এই কারণগুলোর জন্য দায়ী নয়, কিন্তু তাদেরকেই মাশুল দিতে হয় বেশি। তাদেরকে ঞড়রষরহম গধংং বলা হয়। এর অর্থ, মেহনতি জনতা। তারা আর কত দিন মেহনত বা কষ্ট করবে? বাজারের আগুন না নিভলে তাদের মনের আগুনও নিভবে না। কিন্তু বাজারের আগুন থামাবে কে? যারা থামানোর, তারাই উসকে দেয়। কথায় বলে, ‘যে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে’। পণ্যমূল্যের আগুনও সবখানে ছড়িয়ে গিয়েছে। কারণ সব জায়গায়ই মেহনতি মানুষ আছে। মূল্যের অগ্নিশিখা শুধু দাউ দাউ করে উপরের দিকে ওঠে, নিচে আর নামে না। এ আগুন নেভানোর মতন কেউ আছেন কি না। অনেক দিন আগে থেকেই বাজারে নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য। দৈনন্দিন জীবন ধারণের সব ক’টি পণ্যের দাম কেবলই বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সরকারও বিব্রত মূল্যস্ফীতির কারণে। এবার বাজেট পেশের সময়ে সরকারি মহলও বলছেন, ‘আমরাও মূল্যস্ফীতির কারণে আশঙ্কা করছি’। সরকারের মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
আয়-বৈষম্য, বেকারত্ব, দারিদ্র্য ইত্যাদির শিকার বেশি স্বল্পবিত্ত জনগণ। করোনাকালের পরপরই ‘সানেম’, সিপিডি প্রভৃতি বেসরকারি সংগঠন দেশে জরিপ চালিয়েছে এই ব্যাপারে। তারা দেখেছেন, নিন্মবিত্ত মানুষই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহায়। বিশ্বের মূল্যস্ফীতির কারণে নয়; মূলত কিছু অসৎ লোকের কারসাজির দরুন এই অবস্থা। বিত্তহীন মানুষই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছে। তারাই সবচেয়ে বেশি অভাবে পড়ে।
খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তাদেরকে কম খেতে হয়। (যেমন- আগের ১০০ টাকার জিনিসের দাম ১৬০ টাকা, ফলে তাদেরকে খরচ কমাতে হয়েছে। এ কারণে তারা প্রয়োজন থাকলেও খেতে পারে না।) এ দিকে চিঁড়া গুড়ের মতো জিনিসেরও দাম কয়েকগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। গরিব মানুষ মোটা চাল বেশি খায়, কিন্তু মোটা চালের দাম বেশি। নিন্মবিত্ত মানুষ তাদের সন্তানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে।