গতকাল গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি ঠিক করতে ওয়ার্কশপে গিয়েছিলাম। আমি ওয়ার্কশপে ঢুকতেই বিদ্যুৎ চলে গেল। ওয়ার্কশপের মালিক বহুদিন ধরে আমার ‘কোনোমতে চাকা ঘোরে টাইপ’ গাড়ির দেখভাল করেন। বেশ বড় গ্যারেজ। দু’তিন ডজন শ্রমিক কাজ করেন। এখানেও শ্রম বিভাজন আছে। কেউ ইঞ্জিন মিস্ত্রি, কেউ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কেউ গ্যাস মিস্ত্রি। অনেকেই আছেন, যারা ডেন্ট-পেইন্টের কাজ করেন। মালিক সামনে আসতেই আমার গাড়ির চালক তাকে বললেন স্যার, গাড়িতে এই এই সমস্যা। গ্যারেজ মালিক হাসতে থাকলেন। বললেন, ২০/২২ বছরের পুরানো গাড়ি। এসব ছোট-খাট সমস্যা নিয়েই গাড়ি চালাতে হবে। স্যারকে তো গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ বলছি গাড়িটি বদলান। আমি বললাম গাড়িটি যে এখনো মাঝেমধ্যে চলে সেই শুকরিয়া। গাড়ি বদলানোর সাধ্য আমার নেই।
বিদ্যুৎ যখন গেছে তখন বিদ্যুৎ আবার আসতে ঘন্টাখানেক তো লাগবেই। গ্যারেজটার সামনে খানিকটা খোলা চত্বর আছে। কিন্তু জ্যৈষ্ঠের খরতাপে সেখানে বসার কোনো উপায় নেই। তাই গ্যারেজের ভেতরে বসেই আমরা কথা বলছিলাম। শ্রমিকরা দরদর করে ঘামছিলেন। তিনি বললেন, শুনেছি বিএনপির আমলে মাত্র ৩৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতো। বিদ্যুতের অবস্থা এমনই ছিলো। যেতো আসতো। লোডশেডিং ছিলো। এখন নাকি ২৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। কিন্তু কই বিদু্যুতের অবস্থা তো দেখি তার চেয়েও খারাপ। বিদ্যুৎ নিয়ে পার্লামেন্টে মন্ত্রী-এমপিরা কত রকম কৌতুককর কথা যে বলেন, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এসব কথা বলার সময় তাদের মুখ ভারী আলগা হয়ে যায়। মন্ত্রী বলেন, আর কটাদিন সবুর করো, রসুন বুনেছি। এমপিরা বলেন লাগাম ছাড়া কথা।
আমরা সবুর করছি। সবুর করতে করতে বিদ্যুৎ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ খাত থেকে কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের নামে ব্যাপক লুণ্ঠন চলেছে। সেই লুণ্ঠন এতোই খোলাখুলি ছিলো যে সরকার বিদ্যুৎ খাতে কোনো অনিয়মের অভিযোগ তোলার বিরুদ্ধে আইন জারি করে। সে আইনে বলা হয় বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তারপর থেকে রেন্টাল কুইক রেন্টালের নামে আওয়ামী লীগের ফেউদের লুণ্ঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়। ফলে তারা বিদ্যুৎ খাত থেকে লুটতরাজের ব্যাপক আয়োজন করে। মুদি দোকানদার নামসর্বস্ব কোম্পানিকেও দেওয়া রেন্টাল কুইক রেন্টালের ব্যবসা। এ এক আজব ব্যবসা। সরকার আপনার সঙ্গে চুক্তি করল যে রেন্টাল কুইক রেন্টাল করে বেশি দামে আপনাকে বিদ্যুৎ দেবে। কিন্তু তারা তা দিতে পারলো না। কিন্তু তাকে সরকার থেকে নির্ধারিত অংকে টাকা দিয়ে যেতেই হবে। লুটের এসব সৃষ্টিশীল ফন্দি খুবকমই হয়েছে।
হ্যাঁ, কাজির গরুর মতো সরকার একটা আন্দাজে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাহাদুরি করতে থাকলো। বিশেষজ্ঞরা বললেন, এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। পাত্তা দিল না কেউ। সরকারের তরফে বলা হলো, তারা এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে যে, সেটা সঞ্চালনও করা যাচ্ছে না। যাত্রা দলের নায়িকা এক এমপি তো সুর করে বললেন, তার সরকার এত বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে যে, এখন বিদ্যুৎ নাকি ফেরি করে বিক্রি করতে হবে। বলতে হবে ‘বিদ্যুৎ নেবে গো বিদ্যুৎ।’
না, সে অবস্থা হয়নি। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতায় এখন বিদ্যুৎ খাত মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঢাকায়ই ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। মফস্বলে সারাদিনে তিন-চার ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ’ থাকে না। এ অবস্থা পুষিয়ে নেয়ার জন্য দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। জনগণের ওপর চাপানো হয়েছে, হচ্ছে নতুন নতুন বোঝা। জ¦ালানি সংকটের কথা আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি। এর আগে ডিজেল চালিত বেশকিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করা হয়েছে। এখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও। ডিজেল বা কয়লা আমদানির জন্য যথেষ্ট ডলার সরকারের হাতে নেই। ফলে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ জ¦ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর এখন গলার জোর কমে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাহারি গল্প বলার দিন শেষ হয়ে গেছে। মনে আছে, একবার এক টকশোতে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বিনা বিদ্যুতে কেন ভাড়ার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুওেলাকে কোটি কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। তিনি এতে এমন ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে, বলে বসলেন, যা জানেন না, তা নিয়ে কথা বলবেন না। জনাব হামিদ, এখন কোথায় গেল আপনার সেই সব ফুটানির কথা।
এখন মাঝেমধ্যেই তিনি বলেন, বিদ্যুৎ পাওয়ার তারিখ আর সাতদিন, আর ১৫ দিন, আর এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আামরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় থাকি, সুদিন আর আসে না।
এ কথা শুনতে শুনতে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল যে, বিএনপি এমন অথর্ব সরকার ছিল যে, তারা শুধু খাম্বা লাগিয়েছিল, এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করতে পারেনি। কিন্তু সরকার তো সেই খাম্বা কাজে লাগিয়েছে, বিদ্যুৎ উপাৎন কি বেড়েছে। সন্দেহ নেই বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে, বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন বাড়াতে পারেনি। শুধু বড় বড় কথা, আর হাওয়াই গালভরা বুলি। এই অবস্থা শুধু বিদ্যুৎ খাতেই নয়, সকল উৎপাদনশীল খাতেই বিরাজমান।
এখন বড় গলার সেই কাকিকে খুঁজি, যিনি আইন প্রণেতার দায়িত্ব পালন করতে না পারলেও সংসদকে নাচেগানে ভরপুর করে রেখেছিলেন। যিনি মনে করতেন যে, দেশে বিদ্যুৎ উপচে পড়ছে। ঝুড়িতে করে বিদ্যুৎ নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করতে হবে ‘বিদ্যুৎ নেবে গো বিদ্যুৎ’। আসলে তিনি কি জানেন, বিদ্যুৎ মাপার কায়দা কী ? বিদ্যুৎ কি ঝুড়িতে তোলা যায়? বিদু্যুৎ কি লিটারে বিক্রি হয়? নাকি সের, পোয়া ছটাকে বিক্রি হয়? সেই কাকিকে এখন বলতে ইচ্ছে করে কাকি, বিদ্যুতের ছটাক কত করে। আমি দু’এক ছটাক বেশি বিদ্যুৎ কিনতে চাই।