বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি আরো শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। রাতে-দিনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে দিশেহারা মানুষ। বিদ্যুৎ সঙ্কটের সাথে অস্বাভাবিক গরমে অসহনীয় যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের অবস্থা কাহিল। ঘরে ঘরে রোগী। হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীদের ভিড়।
চিকিৎসকেরা বলছেন, ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের সাথে তাপদাহ এবং সেইসাথে সুপেয় পানির সঙ্কট জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। জ্বর, সর্দি, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। পানি সঙ্কটের কারণে লোকজন অনিরাপদ পানি পান করতে বাধ্য হচ্ছে। তাতে ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-বালাই। স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি টানা লোডশেডিংয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘিœত হচ্ছে। মহানগর ও জেলায় চলছে মশার বেপরোয়া উৎপাত। মশার দৌরাত্ম্য মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
দেশের অন্য এলাকার মতো চট্টগ্রামেও বিদ্যুতের নজিরবিহীন সঙ্কট চলছে। পানি ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে অস্বাভাবিক গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ যা মিলছে তা একেবারেই কম। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং দিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে জ্যৈষ্ঠ মাসেও অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ চলছে। প্রখর রোদ সেইসাথে ভ্যাপসা গরমে মানুষ কাহিল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষের অবস্থা বেহাল। বয়স্ক এবং শিশুরা ও গর্ভবতী মহিলারা গরমে বেশি কাহিল হচ্ছেন। অসুস্থদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। রাস্তায় নামলেই প্রচ- রোদ। বাসা-বাড়িতে নেই বিদ্যুৎ। অফিস-আদালতেও বিদ্যুতের অভাবে প্রাণ ওষ্ঠাগত। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় ফেরার পর লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হচ্ছে। ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে গোসল করার সুযোগও মিলছে না।
বিদ্যুৎ সঙ্কটের সাথে পাল্লা দিয়ে পানি সঙ্কট বেড়েই চলেছে। এবার বৃষ্টিপাত স্বাভাবিকের চেয়ে কম হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এ কারণে গত চার মাসের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির উৎস কর্ণফুলী ও হালদার উজানে অস্বাভাবিক লবণ পানি ঢুকে পড়ছে। এর ফলে ওয়াসার পানিতে মাত্রা অতিরিক্ত লবণ আসছে। লবণের মাত্রা কমাতে জোয়ারের সময় ১২ ঘণ্টা পানি পরিশোধন বন্ধ রাখতে হচ্ছে ওয়াসাকে। আর তাতে ওয়াসার পানি উৎপাদন অর্ধেকের চেয়ে কমে গেছে। দৈনিক চাহিদা যেখানে ৬০ কোটি লিটার সেখানে ২০ থেকে ২৫ কোটি লিটার সরবরাহ দিচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। নগরজুড়ে চলছে পানির হাহাকার। বিদ্যুৎ না থাকায় বহুতল ভবনগুলোতে পানি সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় মহানগরীর দূরবর্তী ও উঁচু এলাকাগুলোতে দিনের পর দিন ওয়াসার পানি মিলছে না। সুপেয় পানির সঙ্কট মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে নগরবাসী।
বিকল্প উৎস থেকে অনিরাপদ পানি ব্যবহার করতে গিয়ে পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানাবিধ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। মহানগরী ও জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অস্বাভাবিক হারে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া। ডায়রিয়া রোগীদের শরীরে মিলছে কলেরা রোগের জীবাণু। বিদ্যুৎ আর পানি সঙ্কটে জনজীবন বিপর্যস্ত। রাতের বেলায়ও দফায় দফায় লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। তাতে স্বাভাবিক ঘুম বিঘিœত হচ্ছে। বিদ্যুৎহীন রাতে ভ্যাপসা গরম থেকে রক্ষা পেতে মশারি ছাড়া শোয়ারও জো নেই। কারণ নগরীতে মশার উৎপাত চলছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। লোডশেডিং, অস্বাভাবিক গরম আর সেইসাথে মশার উৎপাত মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম থাকায় সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসুস্থদের অবস্থা হয়ে পড়ছে আরও নাজুক। পানিশূন্যতা, শারীরিক দুর্বলতা, সর্দি, কাশি, জ্বরসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
মহানগরীর সরকারি-বেসরকারি, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রোগীর চাপ বেড়েছে। সেখানেও নেই স্বস্তি। লোডশেডিংয়ের কারণে হাসপাতালেও রোগীদের হাঁসফাঁস অবস্থা। গরমের তীব্রতা থেকে রক্ষায় ডাব, শরবতসহ কোমল পানীয়ের চাহিদা বেড়েছে। এর ফলে দামও এখন আকাশছোঁয়া। কচি ডাবের দাম সেঞ্চুরি পার করেছে। ফলে এসব জিনিস সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে বাজারে আইপিএস, জেনারেটর ও চার্জ ফ্যান ও লাইটের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ সুযোগে অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন ব্যবসায়ীরা। দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ দামেও এসব ইলেকট্রনিক্স বিক্রি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবন এমনিতেই অতিষ্ঠ। তার উপর বিদ্যুৎ সঙ্কটের কারণে অতিরিক্ত ব্যয় নির্বাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে অনেকে।
এদিকে শিক্ষার্থীরা পড়েছে মহাবিপাকে। বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছে। সামনে এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষা। কিন্তু পড়ালেখার পরিবেশ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। রাতে-দিনে লোডশেডিংয়ে পড়ালেখা মারাত্মক বিঘিœত হচ্ছে।