বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণে প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়েছে। এবার রাজস্ব আদায়ের মরিয়া চেষ্টা দেখা গেছে। সরকারের হাতে খরচ করার মতো টাকাও নেই, ডলারও নেই। সেহেতু খরচ করার টাকা সংগ্রহ করতে চাচ্ছে। আইএমএফ বলেছে, প্রতিবছর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। সেটারও একটি বিষয় রয়েছে। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম ও সিপিডি আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২০২৪: অসুবিধাগ্রস্ত মানুষগুলো কী পেলো?’ শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আইএমএফের প্রথম সমীক্ষা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় সমীক্ষা বছরের শেষ নাগাদ হবে। দ্বিতীয় কিস্তির টাকা পেতে হলে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এত মরিয়া চেষ্টার পরও আধা শতাংশ বর্ধিত করের লক্ষ্যমাত্রা কিন্তু বাজেটে প্রাক্কলন করা সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে তার অনেকগুলো পদক্ষেপের মধ্যে ২ হাজার টাকা সারচার্জসহ অন্যান্যগুলো নি¤œ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষকে প্রভাবিত করবে নেতিবাচকভাবে।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেটি নির্ধারণ করতে হচ্ছে তা বর্তমানের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। এটি সকলেই জানে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। রাজস্ব আদায়ের মরিয়া চেষ্টা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও আইএমএফের শর্ত পূরণের জন্য। কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক ধোলাই হয়নি। রাজনৈতিক ধোলাই যদি হতো, তাহলে সংসদ সদস্য ও স্থায়ী কমিটিগুলোর কাছে নিয়ে যেতেন- এগুলোর অনেকগুলোতেই ওনারা রাজি হতেন না। তার প্রকাশ কিন্তু এখন সংসদ আলোচনায় ক্রমান্বয়ে বের হবে।
গাম্ভীর্য হারিয়ে বাজেট এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর অংশ হয়ে গেছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এবারের বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের সম্পৃক্ততা ছিল না। রাজস্ব আহরণের মরিয়া চেষ্টার ফলে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে, এগুলোকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। এটা যে নির্বাচনী বাজেট না তা লক্ষণীয়। পদক্ষেপগুলো একটি রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায় কতোখানি গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বহু আগে একজন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, প্রত্যেক বাজেটই তো নির্বাচনী বাজেট। আমি গত ৫ বছর ধরেই তো নির্বাচনী বাজেট দিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি রাজনৈতিক উত্তর হতে পারে। নির্বাচনী বাজেটের ভেতর কি থাকে? খরচযোগ্য তদারকিহীন টাকা (লুজ মানি) থাকে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন জায়গায় লুকায়িত অর্থ রয়েছে, যা সামাজিক সুরক্ষা খাতে দেয়া বরাদ্দের চেয়ে বেশি। আপনি যদি জনতুষ্টি চান তাহলে তো সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরও বেশি বরাদ্দ দেবেন। টিসিবি’র ফ্যামিলি কার্ড যেটি দেড় বছর ধরে শুনছি, এখনো জানি না ক’টি কার্ড দিয়েছে, কোন ফ্যামিলি পেলো? তাহলে এটি রাজনীতিহীনভাবে নির্বাচনী বাজেট।
তিনি আরও বলেন, রাজনীতি যদি থাকতো তাহলে জনপ্রতিনিধিরা বলতো ওখানে টাকা দাও, ওখানে খাদ্য সাহায্য দাও। বলতো, শহরের ভেতরে ওএমএসের পরিমাণ আরও বাড়াও, ট্রাকের সংখ্যা বাড়াও, জেলা পর্যায়ে ওএমএস নিয়ে যাও। এই রিটার্ন সনদ পেতে ২ হাজার টাকা- এটা কেউ দেয়? কতো টাকা এটা থেকে আদায় হবে? কেউ বলছে এক হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে। কার্যত এটি থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আদায় হতে পারে। এই ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার জন্য এই সামাজিক সমালোচনা কেউ সহ্য করে। এটি কোনো রাজনৈতিক যুক্তিযুক্ত হতে পারে? এই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিরা ও নাগরিকরা কতোটুকু যুক্ত ছিল? আগে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটির বৈঠক হতো, সর্বশেষ মুহিত সাহেব (প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) স্থায়ী কমিটির সভাপতিদের ডেকে একটি বৈঠক করতেন। এবার সেটাও হয়েছে কিনা আমরা জানি না। এই যে পদক্ষেপগুলো নিয়ে তো রাজনৈতিক দলের ভেতরে আলোচনাই হলো না।
তিনি বলেন, বাজেটে আগে গাম্ভীর্য ছিল, বাজেট এখন অনেক ক্ষেত্রেই প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর অংশ হয়ে গেছে। বাজেটের ভেতর দিয়ে গত ১৫ বছরে সরকারের যে অর্জনগুলো ছিল, শত শত পৃষ্ঠার ভেতর দিয়ে তা মনে দাগ কাটেনি।
সিপিডি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের কোর গ্রুপ সদস্য এডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র সম্মানিত ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে আরও বক্তব্য দেন, সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ও রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
জলবায়ু ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, অন্য সব মন্ত্রণালয়ের মতো জ্বালানি ও জলবায়ু নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের সঙ্গে বাস্তবায়নের ফারাক থেকে যায়। আমরা বাজেট বিশ্লেষণের সময় বলেছি, বাজেট এমন এক সময়ে দেয়া হয়েছে, যখন আমরা আইএমএফের ঋণের আওতায় রয়েছি। সেই শর্ত অনুযায়ী, ১১টি খাতে সংস্কার করতে হবে। এর মধ্যে জলবায়ু খাতে সংস্কারের একটি শর্তও রয়েছে। কিন্তু, বাজেটে আমরা সেটির প্রতিফলন দেখতে পাইনি।
সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের যে সম্পদ আছে, সেটি বণ্টনে নায্যতা নিশ্চিত করা জরুরি। একটি কথা খেয়াল রাখতে হবে, এনবিআর কতো টাকা আয় করতে পারলো, তা নিয়ে কথা বলি। একইভাবে কতো টাকা সাশ্রয় করা যায়, তাও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। আমাদের ১ হাজার ২৫০টির মতো প্রকল্প আছে, যার মধ্যে ৮৭৮টি ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করতে হবে। এর অধিকাংশই আগের প্রকল্প। এই যে ক্যারিওভার প্রকল্প, এগুলোর কারণেই সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে। কেবল বাজেট প্রণয়ন নয়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অনেক বৈসাদৃশ্য রয়ে গেছে। এগুলো এখন প্রতীয়মান হচ্ছে।