কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপিরা প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। পাশাপাশি ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো আবেদন করার যোগ্যও হবেন না। বিভিন্ন নামে বহুসংখ্যক ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে ব্যাংকিং কোম্পানি, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ও ফিনটেক (ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি) কোম্পানি যৌথভাবে আবেদন করতে পারবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রণীত প্রস্তাবিত ডিজিটাল ব্যাংকিং বিষয়ক খসড়া নীতিমালায় এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নীতিমালার খসড়াটি এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে সার্কুলার জারির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে এ বিষয়ে জানাবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের আগ্রহীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হবে। পরে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স পাওয়ার পরই কেবল ব্যবসা শুরু করা যাবে। ব্যবসা শুরুর পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়াবাজারে তালিকাভুক্ত হতে হবে। যে পরিমাণ অর্থ নিয়ে ব্যাংকের ব্যবসা শুরু হয়েছে, সেই পরিমাণ অর্থের শেয়ার বাজারে ছাড়তে হবে।
গত ১ জুন সংসদে উপস্থাপিত জাতীয় বাজেটে অর্থমন্ত্রী একটি ডিজিটাল ব্যাংক চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। এর মাধ্যমে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করা হবে।
সূত্র জানায়, ডিজিটাল ব্যাংকে নগদ অর্থের কোনো লেনদেন হবে না। শুধু অনলাইনে লেনদেন হবে। এর শুধু প্রধান কার্যালয় থাকবে। কোনো শাখা থাকবে না। কোনো এজেন্টও থাকবে না। প্রতিটি ব্যাংকের একটি অ্যাপ এবং অনলাইনে একটি প্ল্যাটফরম থাকবে। তাতে প্রবেশ করে প্রয়োজনীয় লেনদেন করা যাবে। এতে নগদ টাকার ব্যবস্থা বাবদ বছরে ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। নোট জালকারীদের তৎপরতা কমবে। মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতাও কমে যাবে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে জানান, আগামী অর্থবছরে একটি ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন। এর আগে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী দেশে একটি ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমীক্ষা করে দেখবে বলে জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যেই একটি সমীক্ষা করেছে। তবে বাজেট বক্তৃতায় ডিজিটাল মুদ্রা চালুর বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। এরই মধ্যে চীন, ভারত সীমিত আকারে ডিজিটাল মুদ্রা চালু করেছে। সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষণ করছে। ডিজিটাল ব্যাংকও সীমিত আকারে ভারত চালু করেছে। এ বিষয়টিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষণ করছে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে দেশে অনেক ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। তারা বিশেষ কোনো অঞ্চল বা সারা দেশে কার্যক্রম চালাতে পারবে। এ ব্যাংকের পুঁজি কম রাখা হয়েছে। যাতে অনেকে ব্যাংকের জন্য আবেদন করতে পারে।
নীতিমালায় বলা হয়, ডিজিটাল ব্যাংকের জন্য ন্যূনতম মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে শেয়ারের কমপক্ষে হবে ৫০ লাখ টাকার শেয়ার ধারণ করতে হবে। এ হিসাবে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা সাড়ে ১২ কোটি টাকা মূলধন লাগবে। উদ্যোক্তা থাকবেন কমপক্ষে ১০ জন। এর মধ্যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বেশি নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিমালায় বিশেষ সুবিধা নেওয়া যাবে। এটি নির্ভর করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তের ওপর। শক্ত আর্থিক ভিত্তি রয়েছে-এমন কোনো ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা কোম্পানির ক্ষেত্রে নীতিমালায় কিছুটা ছাড় দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের মধ্যেই কয়েকটি ডিজিটাল ব্যাংক দেশে ব্যবসা শুরু করুক। এজন্য নীতিমালায় ছাড় দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে নীতিমালায় পরিপক্বতা আনা হবে। এজন্য বাস্তবতার আলোকে নীতিমালাটিও সংশোধন করা হবে।
নীতিমালায় বলা হয়, এ ব্যাংক পরিচালিত হবে ব্যাংক কোম্পানি আইনের আওতায়। ব্যাংকের পরিচালকের সংখ্যা কত হবে, গ্রাহকদের নিরাপত্তা ও পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জবাবহিদি নিশ্চিতে ব্যাংক কোম্পানি আইনকে অনুসরণ করা হবে। এর আলোকেই নীতিমালাটি প্রণীত হচ্ছে। ওই নীতিমালায় প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনো বিধিবিধান জারি করার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে আমানতকারী বা ব্যাংকের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার প্রমাণ পেলে যে কোনো পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অপসারণ করতে পারবে। আমানতকারীদের স্বার্থে ব্যাংকটিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানতও জমা রাখতে হবে। গ্রাহকদের লেনদেনের জন্য এ ব্যাংক কোনো চেক, কার্ড বা উপকরণ চালু করতে পারবে না। কেবল অ্যাপ বা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দিয়ে গ্রাহক তার হিসাবে প্রবেশ করে টাকা স্থানান্তর করতে পারবেন। লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক থেকে গ্রাহকের মোবাইল বা ই-মেইলে ওটিপি পাঠানো যাবে। এজন্য ব্যাংককে একটি আধুনিক ও নিরাপদ অনলাইন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমেই কেবল লেনদেন হবে। একজন গ্রাহক অন্য গ্রাহককের সঙ্গে যেমন লেনদেন করতে পারবে, তেমনই যে কোনো কেনাকাটার বিলও পরিশোধ করতে পারবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানেও ডিজিটাল ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। আপাতত লেনদেন শুধু ডিজিটাল ব্যাংকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হবে। পরবর্তীকালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সঙ্গেও লেনদেন চালুর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো গ্রাহক কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণখেলাপি হয়ে থাকলে বা আগে ছিলেন, এখন নেই বা এখনো খেলাপি আছেন-এমন কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য কিংবা তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে পারবেন না। এমনকি ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত কোনো আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য রায়ের অপেক্ষায় থাকলেও তিনি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক হতে পারবেন না।
কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, উপদেষ্টা ডিজিটাল ব্যাংকের পরিচালক হতে পারবেন না। তবে আর্থিক খাতবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হলে তার ক্ষেত্রে ব্যাংকেরও পরিচালক হতে কোনো বাধা থাকবে না।
ডিজিটাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদস্যের প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, নতুন নতুন সম্ভাবনাময় প্রযুক্তি, সাইবার আইনকানুন ও হুমকির বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা থাকতে হবে। আর বাকি ৫০ শতাংশ সদস্যের ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও প্রবিধান বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও হতে হলে ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এর মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, আইনকানুন, নীতিমালা, সার্কুলার-এসব বিষয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী প্রধান নির্বাহী নিয়োগ পাবেন।