লোডশেডিংসহ বিদ্যুতের চরম সংকটে দিশেহারা রাজধানীর অধিবাসীরা পানিরও তীব্র সংকটের মুখে পড়েছেন। প্রকৃতপক্ষে রাজধানীতে এবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে গরম শুরু হওয়ার পর থেকে। অবস্থা মারাত্মক হয়েছে বিশেষ করে বিগত কয়েকদিনে, রাজধানীতে যখন বিদ্যুতের সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। গতকাল পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, এমন কোনো এলাকার কথা বলা যাবে নাÑ যে এলাকার মানুষ পানির সংকটের শিকার না হয়েছে। বাস্তবে ঢাকার সকল এলাকার মানুষই সংকটের কবলে পড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেকেরটেক, জুরাইন মাদরাসা রোড, দনিয়াবাজারসহ বহু এলাকার মানুষ গোসল দূরে থাকুক এমনকি নামাযের আগে ওজু করার মতো পানিও পাচ্ছেন না। উত্তরার মতো অভিজাত এলাকার মানুষেরাও পানির জন্য এদিক-সেদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। কলস ইত্যাদি গাড়িতে ওঠাচ্ছেন। যাদের গাড়ি নেই তারা লজ্জা-শরমের বালাই ঝেড়ে প্রকাশ্যে কলস ও পানির অন্য ধরনের পাত্রসহ ঘুরে ফিরছেন। এসব এলাকার মসজিদ ব্যবস্থাপকরা ওয়াক্তিয়া নামাযের আগে মুসল্লীদের যার যার বাসা থেকে ওজু করে আসার অনুরোধ জানিয়ে মাইকে ঘোষণা প্রচার করতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনো কোনো এলাকার মানুষ ভোর হতে না হতে বালতি ও কলসি নিয়ে এলাকার পানির ট্যাংকের সামনে গিয়ে লাইনেও দাঁড়াচ্ছেন। সেখান থেকে অনেক কষ্টে নিয়ে আসা পানি দিয়েই তাদের বাসাবাড়িতে কোনোভাবে সারাদিনের রান্নাবান্নাসহ সব কাজ সারা হচ্ছে।
অভিজাত অনেক ফ্ল্যাটে বসবাসকারীদের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়েছে। গণমাধ্যমের রিপোর্টে বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকার এমন একটি হাউজিং সোসাইটির কথা জানানো হয়েছে যেখানে তিনশ’র বেশি ফ্ল্যাট রয়েছে। পানি না পাওয়ার কারণে ওই সোসাইটির পক্ষ থেকে পানি সরবরাহকারী সংস্থার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর ওই সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা নাকি সমস্যা দূর করার জন্য ঘুস দাবি করেছেন! এই ঘুসের অর্থ যোগাড় করার জন্য সোসাইটির ব্যবস্থাপকরা আবার প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিকের কাছে এক হাজার টাকা করে চেয়ে নোটিস পাঠিয়েছেন। এভাবে তিনশ’ মালিকের কাছ থেকে এক হাজার করে অন্তত তিন লাখ টাকা যোগাড় হলে সেই টাকা সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের ঘুস হিসেবে দেয়া হবে। তারপর নাকি পানি সরবরাহ নিশ্চিত করবে সংস্থাটি! সোসাইটির ব্যবস্থাপক এবং ফ্ল্যাট মালিকরা জানিয়েছেন, এই ঘুস দিতে হবে শুধু চলতি গরমের এক মাসের পানির জন্য। পরবর্তীকালে নিয়মিতভাবে পানি পেতে হলে আরো ঘুসের কথা আগাম জানিয়ে রেখেছেন সংস্থাটির কর্তা ব্যক্তিরা!
বলার অপেক্ষা রাখে না, একদিকে সমগ্র রাজধানীতে তীব্র পানির সংকট এবং অন্যদিকে কর্তা ব্যক্তিদের খোলামেলা ঘুসের বাণিজ্যÑএমন অবস্থা কোনোক্রমেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। ঘটনাপ্রবাহে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, সংকট আসলে সুচিন্তিতভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, মাত্র কিছুদিন আগেই এক গণশুনানিতে পানি সরবরাহকারী সংস্থা ওয়াসার কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছিলেন, তারা প্রতিদিন ২৪৫ থেকে ২৫০ কোটি লিটার পর্যন্ত পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করতে সক্ষম। এদিকে পুরো রাজধানীতে বর্তমানে চাহিদা রয়েছে ২৪০ কোটি লিটার পানির। সে হিসাবে সংকটের পরিবর্তে বরং ৫ থেকে ১০ কোটি লিটার পানি উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে অবস্থা এতটাই মারাত্মক হয়েছে যখন এমনকি ওজু করার মতো পানিও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক এলাকায় খাবার পানিরও মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। শিশুদের খাওয়ানোর এবং শিশুদের জন্য দুধ বানানোর পানিও পাচ্ছেন না মায়েরা। ওদিকে একই সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা আবার ‘নগদ নারায়ণের’ বিনিময়ে রাজধানীরই বিভিন্নস্থানে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করছেন! কোনো কোনো এলাকায় ক্ষমতাসীনদের প্রিয়জন হিসেবে পরিচিতজনদের বাসা ও অফিসেও নাকি পানি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে!
সব মিলিয়েই আমরা এই সময়ে চরম গরমের দিনগুলোতে ওয়াসার কার্যক্রমকে অগ্রহণযোগ্য মনে করি এবং ঘুস বাণিজ্য ও সুচিন্তিতভাবে সৃষ্ট পানি সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। আমরা মনে করি, গ্রীষ্মকালে এমনিতেই যেহেতু পানির চাহিদা অনেক বেড়ে যায় সেহেতু ওয়াসা কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অনেক আগে থেকে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ব্যাপারে পরিকল্পনা করা এবং উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নেয়া। আমরা আশা করতে চাই, ওয়াসা নিজেই যেহেতু ২৫০ কোটি লিটার পর্যন্ত পানি উৎপাদন ও সরবরাহ করতে সক্ষম বলে জানিয়ে রেখেছে সেহেতু কর্তা ব্যক্তিরা রাজধানীবাসীদের পানির সংকট থেকে মুক্তি দেয়ার জরুরি ব্যবস্থা নেবেন। একথা বুঝতে হবে যে, বিদ্যুতের সঙ্গে পানির উৎপাদন বাড়ানোর যেহেতু ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে সেহেতু কোনো একটিকে বাদ রেখে অন্যটির সমাধান করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত হওয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। এজন্যই এমন সুচিন্তিত পরিকল্পনা করা দরকার, যাতে পানি ও বিদ্যুৎ দুটিরই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়। আমরা জ্বালানি, খনিজ ও বিদ্যুতের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের দায়িত্বশীল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তাদের উচিত দ্রুত সংকট কাটিয়ে ওঠার এবং রাজধানীর অধিবাসীদের স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা।