রবিবার রাত সাড়ে ১০টা। রাজধানীর প্রগতি সরণি হয়ে কুড়িল উড়াল সড়ক মোড় ব্যবহার করে টঙ্গীর পথে যাচ্ছিল পণ্যবোঝাই ট্রাক। ৩০০ ফুটের কাছাকাছি উড়াল সড়কের মোড়ে ওঠার জায়গায় (র্যাম্প) এসে ট্রাকের গতি হঠাৎ কমে গেল। তারপর এই সড়কের খিলক্ষেত পর্যন্ত ট্রাকটি চলল ধীরগতিতে।
পরিবহনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পথ ব্যবহারকারী সব ভারী যানকেই উড়াল সড়কের এই অংশে ধীরগতিতে চলাচল করতে হয়। উল্টো দিকে একই রকম অবস্থা খিলক্ষেত থেকে ৩০০ ফুটমুখী উড়াল সড়কটির। এই পথেও স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালাতে পারেন না চালকরা।
ট্রাকচালক মোহাম্মদ জয়নাল মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারের এই দিক দিয়া খালি গাড়ি টানা যায়; কিন্তু গাড়িতে মাল লোড থাকলে মনে হয় ফ্লাইওভার কাঁপে।
তাই কিছুটা আস্তে এই রাস্তা পার হই।’
যান চলাচলের জন্য চালু হওয়ার মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই অবকাঠামোগত এই পরিস্থিতিতে পড়েছে কুড়িল উড়াল সড়কটি। নির্মাণের আগে এর আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ৮০ বছর। মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব ও নিরাপত্তা ত্রুটির কারণেই ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত উড়ালপথটিতে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
এর সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, এই উড়ালপথের নকশায় ত্রুটি আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এজাতীয় বড় প্রকল্পে বৈদ্যুতিক, নিরাপত্তা ও অবকাঠামো—এই তিন খাতে রক্ষণাবেক্ষণ চালু রাখতে হয়; কিন্তু এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর যে পরিমাণ অবকাঠামোগত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি। ফলে আস্তে আস্তে এতে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
উড়াল সড়ক মোড়ের খিলক্ষেত থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত অংশটিতে পণ্যবাহী গাড়ি উঠলেই কেন সেটা কাঁপছে—এমন প্রশ্নের জবাবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোনো ত্রুটি আছে কি না। অনেক সময় অতিরিক্ত ওজন বহনের ফলেও এমনটি হতে পারে।
’
কুড়িল মোড়ে বিমানবন্দর সড়ক ও প্রগতি সরণির সংযোগস্থলে এই উড়াল সড়ক মোড়টি করা হয়েছিল নগরীর উত্তর-পশ্চিম অংশের পরিবহন যোগাযোগব্যবস্থাকে উন্নত করতে। এতে ঢাকার সঙ্গে যেমন পূর্বাচল নতুন শহরের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে, তেমনি বিমানবন্দর সড়ক ও প্রগতি সরণি সংযোগস্থলে যানজট কমেছে। দুই কিলোমিটার সংযোগ সড়ক এবং ৩.১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই উড়াল সড়ক প্রকল্প ২০১৩ সালে বাস্তবায়িত হয়। খরচ হয় ৩০৬ কোটি টাকা।
প্রকল্পের পরিকল্পনা করেছিলেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামছুল হক। প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, কোনো একটা কিছু তৈরি করে ভুলে গেলে চলবে না। একটা বড় অবকাঠামোর নির্মাণ শেষ মানেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়া নয়। এটা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।
শামছুল হক বলেন, ঝুঁকি পরীক্ষা করা এখন খুব কঠিন নয়। যন্ত্রের মাধ্যমে ঝুঁকি পরীক্ষা করে দেখা যায়। যদি পূর্ণ ঝুঁকি পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
নকশায় ত্রুটি : পরিকল্পনা অনুযায়ী, চার ঘূর্ণিতে (লুপ) তিনটি ‘ওয়াই লুপ’ ও দুটি ‘ইউ লুপ’ সড়কের মিশ্রণে উড়াল সড়ক মোড়টি তৈরি করা হয়েছে। এতে ওঠানামার ১০টি পথ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ ফুটের কাছাকাছি তিনটি পথের অবস্থান বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ব্যবহারকারীরা মনে করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শেওড়া রেলগেট পার হয়ে বিশ্বরোড থেকে এবং খিলক্ষেত থেকে উঠে ৩০০ ফুটের সড়কে সরাসরি নামলে তেমন সমস্যা হয় না। তবে বিশ্বরোডের প্রগতি সরণি প্রান্তে গাড়ি নামার সময় সমস্যা হয়। তখন সমতলের গাড়িগুলোও ডান ও বাঁ—দুই দিকেই যেতে থাকে।
আবার উড়াল সড়ক থেকে নেমেও গাড়িগুলো ডান ও বাঁ—দুই দিকেই যায়। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। আবার প্রগতি সরণি প্রান্তে নেমে ৩০০ ফুটের দিকে আসতে আরো দুই জায়গায় বাধার মুখে পড়তে হয়।
আবার ৩০০ ফুট থেকে বের হয়ে সড়কে উঠে উল্টো বাঁক নেওয়ার সুযোগ নেই। অবৈধভাবে আড়াআড়ি পথে উড়াল সড়ক মোড়ের নিচে দিয়েই গাড়ি চলাচল করে।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, এই প্রকল্পের নকশায় ত্রুটি রয়েছে। আর রক্ষণাবেক্ষণ তো হচ্ছেই না। এমন পরিস্থিতিতে করণীয় ঠিক করতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি করা যেতে পারে। সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা উচিত।
যেন কৃত্রিম গতিরোধক! : এই উড়ালপথে রেললাইনের মতো সংযোগস্থল আছে, লোহার পাত ব্যবহার করা হয়েছে। পিচ ঢালাই উঁচু হওয়ায় পাতের এই সংযোগস্থলগুলো নিচু হয়ে গেছে। একটু পর পর থাকা এই সংযোগস্থলের ওপর দিয়ে গাড়ি দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় বড় ঝাঁকি লাগে। অনেক সময় গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানোর মতো অবস্থা হয়। তাই নিয়মিত চলাচলকারী গাড়িগুলো সংযোগস্থলে এসে গতি কমিয়ে ফেলে।
এতে উড়ালপথের এই সংযোগস্থলগুলো অনেকটা কৃত্রিম গতিরোধকের মতো হয়ে গেছে। ফলে গতি কমে, বিশেষ করে বিমানবন্দর থেকে ৩০০ ফুটগামী উড়ালপথে যানজট লেগে যায়। যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটির মূল নকশায়ও ব্যত্যয় ঘটছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্প এলাকায় যেমন নিরাপত্তার কমতি রয়েছে, তেমনি রাতে নিয়মিত বাতিও জ্বলে না। উড়ালপথের রেলিংয়ে মরীচিকা ধরেছে। অনেক জায়গায় রেলিং ভেঙে গেছে। প্রগতি সরণি থেকে ৩০০ ফুটের দিকে যেতে উড়াল সড়ক মোড়ের সংযোগ সড়কটির অনেকটা অংশ ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে।
এই সড়কের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের। সওজের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বলেন, উড়ালপথের সংযোগগুলোয় যদি ভালো মানের পাত দিয়ে জোড়া লাগানো হয় তা হলে সেগুলো আট থেকে ১০ বছর টিকে থাকে। তিনি বলেন, ‘যদিও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের; কিন্তু প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে রাজউক। তাই সংযোগস্থলে ব্যবহৃত পাতের মান কেমন ছিল, সেটা আমার জানা নেই। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেলিং ও পাত পরিবর্তন এবং বিভিন্ন জায়গায় রং করার দরকার হলে তা করা হবে।’
https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2023/06/07/1287435