গরমের চোটে আর টিকতে পারলেন না এই নারী। ফুটপাতে শরবতে চুমুক দিয়ে শীতল হওয়ার চেষ্টা। মঙ্গলবার রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় -মাহবুব হোসেন নবীন
রাস্তার পাশে নারীর জটলা দেখে থামলাম। মঙ্গলবার বিকেল ৪টা হলেও আকাশের সূর্যের কোনো দয়ামায়া নেই। তাপ ঢালছে তো ঢালছেই। মায়া যদি কিছু থাকে তা আছে গাছের। কারণ, সে ছায়া দিতে পারে। তিনটি নারী তাদের সন্তানাদি নিয়ে সেই ছায়ায় বসে একে অন্যের মাথার উঁকুন বাছছে। কাছে গিয়ে বলি, ‘এখানে কী করেন?’ যাঁর নাম আসিয়া বানু, তিনি উত্তর দেন– ‘কী হরমু, বস্তিত কারেন্ট নাই, তাই এইহানে আইয়া বইসা আছি।’
জায়গাটা তেজগাঁও; সাতরাস্তা থেকে মহাখালী যাওয়ার পথে চ্যানেল আই ভবনের একটু পরে। রাস্তার পাশে কিছু গাছ। সেটুকু ছায়ার ভরসায় বসে আছেন তাঁরা। আসিয়া বানুর চুলে উঁকুন বাছছিলেন মমতাজ বেগম। তাঁদের পাশে বসা নতুন মা হওয়া প্রেমা। প্রেমার কোলে এক বছরেরও কম বয়সী শিশু।
রাতে তিন-চাইরবার কারেন (বিদ্যুৎ) যায়, ‘পোলাপাইন লইয়া বইসা থাকি। পাখার বাতাস করতে করতে হাত দুইটা ধইরা আসে। কারেন ন থাকলে পানি পাই না’– বলছিলেন মমতাজ বেগম। থাকেন তেজগাঁও রেললাইন বস্তিতে। সেখানে পানি কিনতে হয়। গোসলে ১০ টাকা, বাথরুমে ১০ টাকা, দুই কলসি ১০ টাকা। প্রেমা আগে ফুল ফেরি করতেন। দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যাওয়ার পর এখন ভিক্ষা করে চলেন। থাকেন ১৪ নম্বর বস্তিতে। স্বামী ভ্যান চালান। বলছিলেন তিনি– ‘দিনে রাস্তায় বইয়া থাকি, রাইতে খোলা জায়গায়। পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকা। অভাবের জ্বালায় রাস্তায় বইতে হইছে। ঘরে থাওনের উপায় নাই।’
একটু দূরেই ছায়ায় বসে জিরাচ্ছিলেন আরও দু’জন। মো. জীবন ও মো. রাসেল। জীবন বাদাম বেচেন। রাসেল বেচেন ঝুটকাপড়ের পাপোশ। গরমের কথা জানতে চাওয়ায় বললেন রাসেল– ‘বাসায়ও শান্তি নাই, কারেন্ট যায় ঘণ্টায় ঘণ্টায়। সারাদিন রোদে পুড়ি, বাসায় গিয়া শরীর জ্বলে। লাইনের পানিতে গন্ধ। নিমপাতা দিয়া না ফুটাইলে গোসলডাও করা যায় না। চুলকানি হইয়া যায়।’ এদিকে জীবনের কথা– ‘পাবলিক এখন কিছু কিনতেই চায় না, সবার মেজাজ গরম।’ বস্তিতে ঝগড়াঝাঁটি বাড়ার কথা বলছিলেন আসিয়া বানুও। কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন– ‘বুড়িরা জটলা করে, বুড়িরা জটলা করে আগুনের পাড়ায়।’
সত্যিই আগুনের পাড়া হয়ে আছে ঢাকা শহর। মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে লেবুর শরবত বিক্রি করেন ইমরান। আগে পাঁচ টাকায় বেচতেন। এখন চিনির দাম বাড়ার পর প্রতি গ্লাস শরবতের দাম ১০ টাকা। তাই আগের মতো আর বেচতে পারেন না। এর পরও তাঁর ভ্যান থেকে বিনা পয়সায় দুই গ্লাস পানি খেয়ে গেল দু’জন। তিনি দিলেন। নিকেতন বাজারের মোড়ে কুলফি মালাই বেচেন মাহতাব মিয়া। তাঁর পাঁচ টাকার কুলফির দাম এখন ১০ টাকা। তিনিও জানালেন চিনির দাম বাড়ার কথা।
গুলশান ১-এর মোড়ে মোটরসাইকেল গাছের ছায়ায় রেখে তাঁর ওপর বসে জিরাচ্ছিলেন পাঠাও চালক ইউনুস আলী। গরমের সমস্যা নিয়ে জিজ্ঞেস করি। উত্তর আসে– ‘ভাই, দিনে তিন লিটার পানি কিনা খাই। প্রতি লিটার পানির দাম ২৫-৩০ টাকা। পানির দামও বাড়ছে, কিন্তু কী উপায়। এদিকে রাতে বিদ্যুৎ যায় চারবারের মতো। বিদ্যুৎ গেলে বাসায় পানি থাকে না, গত রাতে গ্যাসও ছিল না।’ ইউনুস আলী থাকেন উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টরের পেছনে জামতলা এলাকায়। দুপুর থেকে বিকেলে ঢাকাই শ্রমজীবীর বড় জটলা হয় হাতিরঝিল এলাকায়। উত্তপ্ত ঢাকার মধ্যে সেখানেই গাছপালার ছায়া আছে, ঝিলের পানিছোঁয়া ঠান্ডা বাতাসও মেলে। তাই এক বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ঝিলপাড়ের বেঞ্চিতে বসে ছিলেন গৃহিণী চামেলী আক্তার। কাছাকাছি বসে ছিলেন স্কুলের দপ্তরি তোফাজ্জল হোসেন। তাঁর কোলেও এক বছরের শিশু। তাঁরা থাকেন মগবাজারের আমবাগান বস্তিতে। দু’জনের কথায় মিল পাওয়া গেল: পানি-গ্যাস-কারেন্টের সমস্যা। এক ঘণ্টা পরপর কারেন্ট যায় আর আসে। রাইতে ঘুমাইতে পারি না। উইঠা বইসা থাকতে হয়। গরমে বাচ্চার পিঠ ঘামাচিতে ভইরা গেছে।
সেখানে আরও কথা হয় মাছ ব্যবসায়ী আবুল হোসেন আর খুদে ব্যবসায়ী আরব আলীর সঙ্গে। গরম আর বিদ্যুতের জ্বালায় তাঁরাও এসে বসেছেন ঝিলপাড়ে। বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের অভাবে বাসায় শান্তি নাই; সেই কথা তাঁদেরও।
তাপদাহ কিংবা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ একা আসে না। সঙ্গে নিয়ে আসে অভাব ও দারিদ্র্য। তাপদাহের হলকায় সব এলাকা আগুনের পাড়া হয় না। যাঁরা হালকা কাপড় পরতে পারেন, থাকতে পারেন এসির ভেতর, করতে পারেন তিন বেলা গোসল, যাঁদের রয়েছে নিজস্ব জেনারেটর কিংবা শীতের দেশে বেড়ানোর সুযোগ; তাঁরা কিছু টের পাবেন না। কিন্তু গরিব মানুষের জন্য এই সময়টা হয়ে ওঠে অসহনীয়। বাতাসে আগুনের মতো হলকা নেভানো তো কোনো দমকল বাহিনীর কাজ নয়; সেই দায়িত্ব সরকারের, যারা বিকল্প ব্যবস্থা করবে। বৃষ্টি আনতে না পারলেও অন্তত ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করবে, দুস্থদের দেবে ত্রাণ।
চলে আসছি আর ভাবছি নিকেতন বাজারের কাছে চার্জে চালানো যায় এমন ছোট্ট ফ্যানের হকার লোকটির কথা। প্যান্ট-শার্ট পরিপাটি করে পরা। দাড়িতে মেহেদি লাগানো। বয়স মনে হয় ৫০ পেরোয়নি। নাম বলতে চাইলেন না। কারণ, গ্রামের বাড়িতে সবাই জানে তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করেন। ঢাকার রাস্তায় হকারি করার গল্প তাঁর স্ত্রী-সন্তানও জানে না। একসময় তাঁর চাকরি ছিল। গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায় নিটিং অপারেটরের চাকরি করতেন। করোনা মহামারির পর কারখানাটি আর খোলেনি; তাঁরও আর চাকরি জোটেনি। কষ্টের কথা যাতে আর বলতে না হয়, সেজন্য হঠাৎ ঘুরে হাঁটা দিলেন। তাঁর সুন্দর দাঁতের হাসিটা নিমেষে নিভে গেল। চোখের কোনায় কি একবিন্দু অশ্রু দেখা গেল? ঢাকা শহরে গরিবদের খাওয়ার পানি দাম দিয়ে কিনতে হলেও চোখের পানি মূল্যহীন!
ফারুক ওয়াসিফ : পরিকল্পনা সম্পাদক, সমকাল; লেখক
farukwasif0@gmail.com