শুনতে ভালো না লাগলেও এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণ সর্বাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে। বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যের সঙ্গে বেড়ে চলেছে গ্যাস-বিদ্যুতের মতো সবকিছুর মূল্যও। উদাহরণ দেয়ার জন্য মুরগির ডিমের কথা উল্লেখ করা যায়। কয়েকদিনের ব্যবধানেই ১২৫-১৩৫ টাকা ডজনের মূল্য বেড়ে হয়েছে ১৪৫-১৫০ টাকা। ওদিকে রীতিমতো আগাম ঘোষণা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাইকারি পর্যায়ের পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে এ পর্যন্ত ১২ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গত পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ানোর সময় সরকারের পক্ষে বিইআরসি একথাও জানিয়ে রেখেছে যে, স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের মূল্য আরো এক দফা বাড়ানো হবে।
একযোগে অন্যসব পণ্যের মূল্যও লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের রিপোর্টে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের লাফিয়ে বেড়ে চলা দামের উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রথম আট বছরে রাজধানী ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৮১ শতাংশ। ওই রিপোর্টে প্রধান কয়েকটি ব্যয়ের পরিসংখ্যান উল্লেখ করে জানানো হয়েছে, সরকারের প্রথম আট বছরে বিদ্যুতের জন্য ব্যয় বেড়েছিল ৯৩ শতাংশ; পানি ও বাসভাড়া বেড়েছিল ৫৬ ও ৪৫ শতাংশ হারে। ২০০৯ সালে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ছিল ২৩ টাকা। অন্যদিকে কোনো কোনো চালের দাম প্রতি কেজির জন্য এমনকি ৮০-৯০ থেকে ১০০ টাকাও আদায় করা হচ্ছে।
বাড়ি ভাড়া প্রসঙ্গেও বিভিন্ন রিপোর্টে ভীতিকর তথ্যই জানা যাচ্ছে। যেমন বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে রাজধানীর সাধারণ বা কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় দুই কক্ষের একটি বাসার মাসিক ভাড়া ছিল ১০ হাজার ৮০০ টাকা। বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ২০২৩ সালে অমন একটি বাসার জন্য কম করে হলেও ২৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। এভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে মানুষের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্্œ আন্তর্জাতিক গবেষণা রিপোর্টে রাজধানী ঢাকাকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ‘সবচেয়ে ব্যয়বহুল’ নগরী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ওদিকে সকল গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, প্রতি কেজি ৭০/৮০, এমনকি ৯০ টাকার নিচে কোনো সবজিই পাওয়া যাচ্ছে না। কাঁচা মরিচ তো রেকর্ডই করে ফেলেছে। মাঝখানে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম এমনকি ৩০০ টাকারও ওপরে চলে গিয়েছিল। সে সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বলে তামাশা করা হয়েছে যে, কাঁচা মরিচের দাম দিয়ে আজকাল মাছ-মাংস এবং মুরগিও কেনা সম্ভব!
এভাবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০৬ সালে চার দলীয় জোট সরকার বিদায় নেয়ার পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে তিন থেকে চার গুণ পর্যন্ত। অন্যদিকে মানুষের আয়-রোজগার বাড়েনি। তাদের জন্য চাকরি বা ব্যবসারও সুযোগ সৃষ্টি করেনি সরকার। সে কারণে সাধারণ মানুষের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। তাদের আসলে নাভিশ্বাস উঠেছে। জানা গেছে, সাড়ে তিন কোটির বেশি মানুষ এরই মধ্যে দু’ বেলা পেট ভরে খেতে পারছে না। ফলে দুর্ভিক্ষের আশংকা করছেন তথ্যাভিজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশে আসলে অঘোষিত দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে গেছে।
এসবের পাশাপাশি সরকারের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূ কোনো উদ্যোগ না নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারেও সরকার সম্ভাবনাময় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মন্ত্রীরা কেবল ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নেয়ার ভয় দেখিয়ে থাকেন। এজন্যই কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দাম কমছে না কোনো পণ্যেরই। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে ব্যবসায়ীরাও যথেচ্ছভাবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। দামও চলে যাচ্ছে মানুষের নাগালের অনেক বাইরে।
পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যানবাহনের ভাড়া যেমন বাড়ানো হচ্ছে তেমনি বাড়ানো হচ্ছে বাড়ি ভাড়াও। অর্থাৎ বিক্রেতা থেকে বাস, রিকশা ও সিএনজিসহ যানবাহনের মালিকরা তো বটেই, বাড়িওয়ালারাও যার যার ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য দাম বাড়িয়ে চলেছেন। মাঝখান দিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
এদিকে মূল্যস্ফীতির দাপটে কমে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃত আয়। গতকালই প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এর ফলেও মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। কোনো একটি প্রসঙ্গেই এখন আর শতকরা হিসাবে হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আমরাও মনে করি, এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে পারে না। সরকারের উচিত কঠোরতার সঙ্গে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার ও পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনার পাশাপাশি আর্থিক খাতেও দুর্নীতি কমিয়ে আনা। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এমন হওয়া দরকার দেশ যাতে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দগুলোর পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গেও সরকারের উচিত পরামর্শ করে পদক্ষেপ নেয়া।